পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য d পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে কিছু বর্ণনা করিয়াছেন তাহা নহে, কিন্তু সর্বত্রই ভালোবাসিবার ও ভালো লাগিব।ার একটা ক্ষমতা দেখাইয়াছেন। পালামীে দেশটা সুসংলগ্ন সুস্পষ্ট জাজ্বল্যমান চিত্রের মতো প্ৰকাশ পায় নাই, কিন্তু যে সহৃদয়তা ও রসবােধ থাকিলে জগতের সর্বত্রই অক্ষয় সৌন্দর্যের সুধাভাণ্ডার উদঘাটিত হইয়া যায় সেই দুর্লভ জিনিসটি তিনি রাখিয়া গিয়াছেন, এবং তাহার হৃদয়ের সেই অনুরাগপূর্ণ মমত্ববৃত্তির কল্যাণকিরণ যাহাকেই স্পর্শ করিয়াছে- কৃষ্ণবৰ্ণ কোলারমণীই হউক, বনসমাকীর্ণ সৌন্দর্য এবং গৌরব অর্পণ করিয়াছে। লেখক যখন যাত্রা-আরম্ভকালে গাড়ি করিয়া বরাকর নদী পার হইতেছেন এমন সময় কুলিদের বালকবালিকারা তাহার গাড়ি ঘিরিয়া “সাহেব একটি পয়সা’ ‘সাহেব একটি পয়সা করিয়া চীৎকার করিতে লাগিল ; লেখক বলিতেছেন- । “এই সময় একটি দুই-বৎসর-বয়স্ক শিশু আসিয়া আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া হাত পাতিয়া দাড়াইল । কেন হাত পাতিল তাহা সে জানে না, সকলে হাত পাতিয়াছে দেখিয়া সেও হাত পাতিল । আমি তাহার হস্তে একটি পয়সা দিলাম, শিশু তাহা ফেলিয়া দিয়া আবার হাত পাতিল ; অন্য বালক সে পয়সা কুড়াইয়া লইলে শিশুর ভগিনীর সহিত তুমুল কলহ বাধিল । সামান্য শিশুর এই শিশুত্বটুকু, তাহার উদ্দেশ্যবোধহীন অনুকরণবৃত্তির এই ক্ষুদ্র উদাহরণটুকুর উপর সঞ্জীবের যে-একটি সকৌতুক স্নেহহাস্য নিপতিত রহিয়াছে সেইটি পাঠকের নিকট রমণীয় ; সেই একটি উলটা-হাতপাত উৰ্ব্বমুখ অজ্ঞান লোভহীন শিশু-ভিক্ষুকের চিত্রটি সমস্ত শিশুজাতির প্রতি আমাদের মনের একটি মধুর রস আকর্ষণ করিয়া আনে। দৃশ্যটি নূতন এবং অসামান্য বলিয়া নহে, পরন্তু পুরাতন এবং সামান্য বলিয়াই আমাদের হৃদয়কে এরূপ বিচলিত করে। শিশুদের মধ্যে আমরা মাঝে মাঝে ইহারই অনুরূপ অনেক ঘটনা দেখিয়া আসিয়াছি, সেইগুলি বিস্মৃতভাবে আমাদের মনের মধ্যে সঞ্চিত ছিল। সঞ্জীবের রচিত চিত্রটি আমাদের সম্মুখে খাড়া হইবামাত্র সেই সকল অপরিস্ফুট স্মৃতি পরিস্ফুট হইয়া উঠিল এবং তৎসহকারে শিশুদের প্রতি আমাদের মেহরাশি ঘনীভূত হইয়া আনন্দরসে পরিণত হইল। চন্দ্রনাথবাবু বলেন, সচরাচর লোকে যাহা দেখে না। সঞ্জাববাবু তাঁহাই দেখিতেন- ইহা তাহার একটি বিশেষত্ব । আমরা বলি, সঞ্জীববাবুর সেই বিশেষত্ব থাকিতে পারে, কিন্তু সাহিত্যে সে বিশেষত্বের কোনো আবশ্যকতা নাই। আমরা পূর্বে যে ঘটনাটি উদধূত করিয়াছি তাহা নুতন লক্ষগোচর বিষয় নহে, তাহার মধ্যে কোনো নূতন চিন্তা বা পর্যবেক্ষণ করিবার কোনো নূতন প্রণালী নাই, কিন্তু তথাপি উহা প্রকৃত সাহিত্যের অঙ্গ। গ্রন্থ হইতে আর-এক অংশ উদধূত করিয়া দিতেছি। লেখক বলিতেছেন, একদিন পাহাড়ের মূলদেশে দাড়াইয়া চীৎকার-শব্দে একটা পোষা কুকুরকে ডাকিবামাত্র পশ্চাতে সেই চীৎকার আশ্চর্যরূপে প্রতিধ্বনিত হইল। পশ্চাৎ ফিরিয়া পাহাড়ের প্রতি চাহিয়া আবার চীৎকার করিলাম, প্রতিধ্বনি আবার পূর্বমত হ্রস্বদীর্ঘ হইতে হইতে পাহাড়ের অপর প্রান্তে চলিয়া গেল। আবার চীৎকার করিলাম, শব্দ পূর্ববৎ পাহাড়ের গায়ে লাগিয়া উচ্চ-নীচ হইতে লাগিল। এইবার বুঝিলাম, শব্দ কোনো-একটি বিশেষ স্তর অবলম্বন করিয়া যায় ; সেই স্তর যেখানে উঠিয়াছে বা নামিয়াছে শব্দও সেইখানে উঠিতে নামিতে থাকে।” ঠিক যেন সেই স্তরটি শব্দ-কনডাকটার।’ ইহা বিজ্ঞান, সম্ভবত ভ্ৰান্ত বিজ্ঞান। ইহা নূতন হইতে পারে, কিন্তু ইহাতে কোনো রসের অবতারণা করে না- আমাদের হৃদয়ের মধ্যে যে-একটি সাহিত্য-কনডাকটর আছে সে স্তরে ইহা প্ৰতিধ্বনিত হয় নী । ইহার পূর্বোদধূত ঘটনাটি অবিসংবাদিত ও পুরাতন, কিন্তু তাহার বর্ণনা আমাদের হৃদয়ের সাহিত্যন্তরে কম্পিত হইতে থাকে । চন্দ্রনাথবাবু তাহার মতের সপক্ষে একটি উদাহরণ প্রয়োগ করিয়াছেন। সেটি আমরা মূল গ্ৰন্থ হইতে আদ্যোপােন্ত উদধূত করিতে ইচ্ছা করি । । (tłow