পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (፩¢ዓ সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য হইত না। নদ-নদীতেও সৌন্দৰ্য আছে, পুষ্পে নক্ষত্রেও সৌন্দর্য আছে, মনুষ্যে পশুপক্ষীতেও সৌন্দৰ্য আছে, এ কথা প্লেটাে না পড়িয়াও আমরা জানিতাম- সেই সৌন্দর্য ভূতের মতো বাহির হইতে আসিয়া বস্তুবিশেষে আবির্ভূত হয় অথবা তাহা বস্তুর এবং আমাদের । প্রকৃতির বিশেষ ধর্মবিশত আমাদের মনের মধ্যে উদিত হয়, সে-সমস্ত তত্ত্বের সহিত সৌন্দৰ্যসম্ভোগের কিছুমাত্র যোগ নাই। একজন নিরক্ষর ব্যক্তিও যখন তাহার প্রিয়মুখকে চাদমুখ বলে তখন সে কোনো বিশেষ তত্ত্ব না পড়িয়াও স্বীকার করে যে যদিচ চাঁদ এবং তাহার প্রিয়জন বস্তুত সম্পূর্ণ ভিন্ন পদার্থ তথাপি চাদের দর্শন হইতে সে যে-জাতীয় সুখ অনুভব করে তাহার প্রিয়মুখ হইতেও ঠিক সেই-জাতীয় সুখের আস্বাদ প্রাপ্ত হয়। চন্দ্রনাথবাবুর সহিত আমাদের মতভেদ কিছু বিস্তারিত করিয়া বলিলাম ; তাহার কারণ এই যে, এই উপায়ে পাঠকগণ অতি সহজে বুঝিতে পরিবেন আমরা সাহিত্যকে কী নজরে দেখিয়া থাকি । এবং ইহাও বুঝিবেন, যাহা প্রকৃতপক্ষে সহজ এবং সর্বজনগম্য আজকালকার সমালোচন-প্ৰণালীতে তাহাকে জটিল করিয়া তুলিয়া পুরাতনকে একটা নূতন ঘরগড়া আকার দিয়া পাঠকের নিকট ধরিবার চেষ্টা করা হয়। ভালো কাব্যের সমালোচনায় পাঠকের হৃদয়ে সৌন্দৰ্য সঞ্চার করিবার দিকে লক্ষ না রাখিয়া নূতন এবং কঠিন কথায় পাঠককে চমৎকৃত করিয়া দিবার প্রয়াস আজকাল দেখা যায় ; তাহাতে সমালোচনা সত্য হয় না, সহজ হয় না, সুন্দর হয় না, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক হইয়া উঠে । গ্রন্থকার কোল-যুবতীদের নৃত্যের যে বর্ণনা করিয়াছেন তাহা উদধূত করি।-- “এই সময় দলে দলে গ্রামস্থ যুবতীরা আসিয়া জমিতে লাগিল ; তাহারা আসিয়াই যুবাদিগের প্রতি উপহাস আরম্ভ করিল, সঙ্গে সঙ্গে বড়ো হাসির ঘটা পড়িয়া গেল। উপহাস আমি কিছুই বুঝিতে পরিলাম না ; কেবল অনুভবে স্থির করিলাম যে, যুবারা ঠকিয়া গেল । ঠকিবার কথা, যুবা হাস্য-উপহাস্য শেষ হইলে নৃত্যের উদযোগ আরম্ভ হইল। যুবতী সকলে হাত-ধরাধরি করিয়া অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি রেখা বিন্যাস করিয়া দাড়াইল । দেখিতে বড়ো চমৎকার হইল। সকলগুলিই সম-উচ্চ, সকলগুলিই পাথুরে কালো ; সকলেরই অনাবৃত দেহ ; সকলেরই সেই অনাবৃত বক্ষে আরসির ধুকধুক চন্দ্ৰকিরণে এক-একবার জ্বলিয়া উঠিতেছে। আবার সকলের মাথায় বনপুষ্প, কৰ্ণে বনপুষ্প, ওষ্ঠে হাসি। সকলেই আহিলাদে পরিপূর্ণ, আহলাদে চঞ্চল, যেন তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় সকলেই দেহবেগ সংযম করিতেছে । ‘সম্মুখে যুবারা দাড়াইয়া, যুবাদের পশ্চাতে মৃন্ময়মঞ্চোপরি বৃদ্ধেরা এবং তৎসঙ্গে এই নিরাধম। বৃদ্ধের ইঙ্গিত করিলে যুবাদের দলে মাদল বাজিল, অমনি যুবতীদের দেহ যেন শিহরিয়া উঠিল। যদি সুরের কােলাহল থাকে, তবে যুবতীদের দেহে কােলাহলপডিয়া গেল, পরেই তাহারা নৃত্যু আরম্ভ तक् ।।' এই বর্ণনাটি সুন্দর, ইহা ছাড়া আর কী বলিবার আছে ? এবং ইহা অপেক্ষা প্ৰশংসার বিষয়ই বা কী হইতে পারে ? নৃত্যের পূর্বে আহলাদে চঞ্চল যুবতীগণ তেজঃপুঞ্জ অশ্বের ন্যায় দেহবেগ সংযত করিয়া আছে, এ কথায় যে চিত্র আমাদের মনে উদয় হয় সে আমাদের কল্পনাশক্তিপ্রভাবে হয়, কোনো বিশেষ তত্ত্বজ্ঞান-দ্বারা হয় না। “যুবতীদের দেহে কোলাহল পড়িয়া গেল' এ কথা বলিলে ত্বরিত আমাদের মনে একটা ভাবের উদয় হয় ; যে কথাটা সহজে বর্ণনা করা দুরূহ তাহা ঐ উপমা-দ্বারা এক পলকে আমাদের হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া যায়। নৃত্যের বাদ্য বাজিবামাত্র চিরাভ্যাসক্রমে কোল রমণীদের সর্বাঙ্গে একটা উদাম উৎসাহচাঞ্চল্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিল, তৎক্ষণাৎ তাহদের প্রত্যেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে - যেন একটা জানাজানি কানাকানি, একটা সচকিত উদ্যম, একটা উৎসবের আয়োজন পড়িয়া গেলযদি আমাদের দিব্যকর্ণ থাকিত তবে যেন আমরা তাহাদের নৃত্যবেগে উল্লসিত দেহের কলকোলাহল শুনিতে পাইতাম । নৃত্যবাদ্যের প্রথম আঘাতমাত্রেই যৌবনসন্নদ্ধ কোলাঙ্গানাগণের অঙ্গে প্রত্যঙ্গে বিভঙ্গিত এই-যে একটা হিল্লোল ইহা এমন সূক্ষ্ম, ইহার এতটা কেবল আমাদের অনুমানবোধ্য এবং