পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(*(ty রবীন্দ্র-রচনাবলী ভাবগম্য যে, তাহা বৰ্ণনায় পরিস্ফুট করিতে হইলে ‘কোলাহলের উপমা অবলম্বন করিতে হয়, এতদব্যতীত ইহার মধ্যে আর-কোনো গুঢ়তত্ত্ব নাই। যদি এই উপমা-দ্বারা লেখকের মনোগত ভাব, পরিস্ফুট না হইয়া থাকে, তবে ইহার অন্য কোনাে সার্থকতা নাই, তবে ইহা প্ৰলাপেক্তি মাত্র। বসন্তাপুষ্পাভরণা গীেরী যখন পদ্মবীজমালা হন্তে মহাদেবের তপোবনে প্রবেশ করিতেছেন তখন কালিদাস র্তাহাকে সঞ্চারিণী পাল্পবিনী লতেব বলিয়াছেন ; সঙ্গিনী।পরিবৃতা সুন্দরী রাধিক যখন দৃষ্টিপথে প্রবেশ করিলেন তখন গোবিন্দদাস র্তাহাকে মোহিনী পঞ্চম রাগিণীর সহিত তুলনা করিয়াছেন ; তঁহাদের কোনো বিশেষ সৌন্দর্যতত্ত্ব ছিল কি না জানি না, কিন্তু এরূপ বিসদৃশ উপমাপ্রয়োগের তাৎপর্য এই যে, দক্ষিণ-বায়ুতে বসন্তকালের পল্লবে-ভরা লতার আন্দোলন আমরা অনেকবার দেখিয়াছি; তাহার সেই সৌন্দর্যভঙ্গি আমাদের নিকট সুপরিচিত ; সেই উপমাটি প্রয়ােগ করিবামাত্র আমাদের বহুকালের সঞ্চিত পরিচিত একটি সৌন্দৰ্যভাবে ভূষিত হইয়া এক কথায় গীেরী আমাদের হৃদয়ে জাজ্বল্যমান হইয়া উঠেন ; আমরা জানি রাগিণী আমাদের মনে কী-একটি বর্ণনাতীত সৌন্দর্যের ব্যাকুলতা সঞ্চার করে, এইজন্য পঞ্চম রাগিণীর সহিত রাধিকার তুলনা করিবামাত্র আমাদের মনে যে-একটি অনিৰ্দেশ্য অথচ চিরপরিচিত মধুর ভাবের উদ্রেক হয় তাহা কোনো বর্ণনাবাহুল্যের দ্বারা হইত না ; অতএব দেখা যাইতেছে, অদ্য সৌন্দর্যরাজ্যে সঞ্জাববাবুর্তাহার নিজের রচিত একটা নূতন গলি কাটেন নাই, সমুদয় ভাবুক ও কবিবর্গের পুরাতন রাজপথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন এবং সেই র্তাহার গৌরব । সঞ্জীব একটি যুবতীর বর্ণনার মধ্যে বলিয়াছেন‘তাহার যুগ্ম ভু দেখিয়া আমার মনে হইল যেন অতি উর্ধে নীল আকাশে কোনো বৃহৎ পক্ষী পক্ষ বিস্তার করিয়া ভাসিতেছে।” এই উপমাটি পড়িবামাত্ৰ মনে বড়ো একটি আনন্দের উদয় হয় ; কেবলমাত্র উপমাসাদৃশ্য তাহার কারণ নহে, কিন্তু সেই সাদৃশ্যটুকুকে উপলক্ষমাত্র করিয়া একটা সৌন্দর্যের সহিত আর-কতকগুলি সৌন্দর্য জড়িত হইয়া যায়- সে একটা ইন্দ্ৰজালের মতো ; ঠিক করিয়া বলা শক্ত যে, অপরাহুের অতিদূর নির্মল নীলাকাশে ভাসমান স্থিরপক্ষ স্থগিতগতি পাখিটিকে দেখিতেছি, না, যুবতীর শুভ্ৰসুন্দর ললাটতলে অঙ্কিত একটি জোড়া ভুরু আমাদের চক্ষে পড়িতেছে। জানি না, কেমন করিয়া কী মন্ত্রবলে একটি ক্ষুদ্র ললাটের উপর সহসা আলোকধৌত নীলাম্বরের অনন্ত বিস্তার আসিয়া পড়ে এবং মনে হয় যেন রমণীমুখের সেই ভুযুগল দেখিতে স্থিরদৃষ্টিকে বহু উচ্চে বহু দূরে প্রসারিত করিয়া দিতে হয়। এই প্রায় হঠাৎ এইরূপ একটা বিত্র উৎপন্ন করে—কিন্তু সেই হলে আিহলেই ঈর্ষকীভূত হয় অবশেষে গ্ৰন্থ হইতে একটি সরল বৰ্ণনার উদাহরণ দিয়া প্রবন্ধের উপসংহার করি । গ্রন্থকার একটি নিদ্রিত বাঘের বর্ণনা করিতেছেন ‘প্রাঙ্গণের এক পাৰ্থে ব্যাঘ্র নিরীহ ভালোমানুষের ন্যায় চোখ বুজিয়া আছে ; মুখের নিকট সুন্দর নখরসংযুক্ত একটি থাবা দর্পণের ন্যায় ধরিয়া নিদ্রা যাইতেছে। বোধ হয় নিদ্রার পূর্বে থাবাটি একবার চাটিয়াছিল।” 朝 আহারপরিতৃপ্ত সুপ্তশান্ত ব্যান্ত্রটি ঐ-যে মুখের সামনে একটি থাবা উলটাইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়ছে, এই এক কথায় ঘুমন্ত বাঘের ছবিটি যেমন সুস্পষ্ট সত্য হইয়া উঠিয়াছে এমন আর-কিছুতে হইতে পারিত না। সঞ্জীব বালকের ন্যায় সকল জিনিস সজীব কীেতুহলের সহিত দেখিতেন এবং প্ৰবীণ চিত্রকারের ন্যায় তাহার প্রধান অংশগুলি নির্বাচন করিয়া লইয়া তাহার চিত্রকে পরিস্ফুট করিয়া তুলিতেন এবং ভাবুকের ন্যায় সকলের মধ্যেই তাহার নিজের একটি হৃদয়াংশ যোগ করিয়া দিতেন । ¢ $७०७