পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

& Vv রবীন্দ্র-রচনাবলী অনুসারে গড়ে- কোথাও তাহার মধ্যে ব্যতিক্রম বা আত্মবিরোধ রাখিতে পারে না। প্রকৃত বড়ো জিনিসের অসম্পূর্ণতাও তাহার বড়োতৃত্ব সূচনা করে ; প্রকৃতি একটা পর্বতকে নিখুঁত মণ্ডলাকার করিবার আবশ্যক বোধ করে না- তাহার সমস্ত ভাঙাচোরা- তাহার সমস্ত অযত্ন-অবহেলা লইয়াও সে অভ্ৰভেদী রাজগীেরবগর্বিত। সে আপন অপূর্ণতাগুলি এমন অনায়াসে বহন করিতে পারে যে, তাহার অপূর্ণতার দ্বারা তাহার প্রকাণ্ড সম্পূর্ণতার পরিমাপ হইয়া থাকে। ক্ষুদ্র বস্তুতে সামান্য অপূর্ণত। মারাত্মক- তাহার প্রতি দৃষ্টি এবং শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে হইলে তাহাকে নিখুঁত করাই আবশ্যক হইয়া পড়ে । মহাভারতকার কবি যে-একটি বীরসমাজ সৃষ্টি করিয়াছেন তাহাদের মধ্যে একটি সুমহৎ সামঞ্জস্য আছে কিন্তু ক্ষুদ্র সুসংগতি নাই। খুব সম্ভব, আধুনিক খ্যাত-অখ্যাত অনেক আৰ্য বাঙালি লেখকই সরলা বিমলা দামিনী যামিনী – নামধেয় এমন-সকল সতীচরিত্রের সৃষ্টি করিতে পারেন র্যাহারা আদ্যোপােন্তসুসংগত অপূর্ব নৈতিকগুণে দ্ৰৌপদীকে পদে পদে পরাভূত করিতে পারেন, কিন্তু তথাপি, মহাভারতের দ্ৰৌপদী তাহার সমস্ত অপূর্ণতা অসংকোচে বক্ষে বহন করিয়া এই সমস্ত নব্য বশীকরচিত ক্ষুদ্র নীতিস্তৃপগুলির বহু উর্ধে উদার আদিম অপর্যাপ্ত প্রবল মাহান্ত্র্যে নিত্যকাল বিরাজ করিতে থাকিবেন । মহাভারতের কর্ণ সভাপর্বে পাণ্ডবদের প্রতি যে-সকল হীনতাচরণ করিয়াছেন আমাদের নাটক-নভেলের দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বগ কখনোই তাহা করেন না, তাহারা সময়ে-অসময়ে স্থানে-অস্থানে অনায়াসেই আত্মবিসর্জন করিয়া থাকেন, তথাপি মহাভারতের কবি বিনা চেষ্টায় কর্ণকে যে অমরলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিয়াছেন এই দীনেশ রমেশ গণেশ ধনেশ -বগ সমালোচকপ্রদত্ত সমস্ত ফাস্ট ক্লাস টিকিট এবং নৈতিক পাথেয় লইয়াও তাহার নিম্নতম সোপান পর্যন্ত পৌছিতে পারে दिक न्ा अgन्ाठ् । সেই কারণেই বলিতেছিলাম, প্রথম স্তরের মহাভারতকার কবি যদি কৃষ্ণকে দেবতা বলিয়া মানিতেন না ইহা সত্য হয়, তবে তিনি যে তাহাকে নীতিশিক্ষার অখণ্ড উদাহরণ-স্বরূপ গড়িয়াছিলেন ইহা আমাদের নিকট সম্ভবপর বোধ হয় না । বঙ্কিম মহাভারতের প্রথমস্তর-রচয়িতাকে শ্রেষ্ঠ কবি অসংগতি-অসম্পূর্ণতা বাদ দিয়াছেন। কিন্তু আমরা বলিতেছি, সেই শ্রেষ্ঠতার লক্ষণ যে সংগতি তাহা নহে । এ পর্যন্ত হ্যামলেট চরিত্রের সংগতি কেহ সন্তোষজনকরপে আবিষ্কার করিতে পারে নাই, কিন্তু কাব্যজগতের মধ্যে হ্যামলেট যে একটি পরম স্বাভাবিক সৃষ্টি সে বিষয়ে কেহ সন্দেহ প্ৰকাশ করে নাই। অতএব, বঙ্কিম মহাভারতের কৃষ্ণচরিত্র হইতে সমস্ত মন্দ অংশ বাদ দিয়া যে আদিম মহাভারতকারের আদর্শ কৃষ্ণকেই আবিষ্কার করিয়াছেন, সে বিষয়ে আমাদের সম্পূর্ণ সন্দেহ আছে। এক্ষণে কথা এই যে, মহাভারতকারের আদর্শ না-ই হইল, বঙ্কিমের আদর্শ যদি যথার্থ মহৎ হয় তবে সেও বঙ্গীয় পাঠকদের পক্ষে পরম লাভ বলিতে হইবে । বঙ্কিমের আদর্শ যে মহৎ এবং কৃষ্ণচরিত্র” যে বঙ্গসাহিত্যের পরম লাভ সে বিষয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নাই । । কিন্তু সেইজন্যই 'কৃষ্ণচরিত্র পাঠ করিতে সর্বদাই মনে এই খেদ উপস্থিত হয় যে, সাহিত্যে যে প্ৰণালীতে আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিতে হয় বঙ্কিম সে প্ৰণালী অবলম্বন করেন নাই । ফুড যে বলিয়াছেন, মহৎ লোকের মাহাত্ম্য ইতিহাস যথার্থীরাপে প্ৰকাশ করিতে পারে না, কাব্য পারে, সে কথা সত্য। কারণ, মাহাত্ম্য পদার্থটি পাঠকের মনে অখণ্ডভাবে সজীবভাবে সঞ্চার করিয়া দিবার জিনিস। তাহা তৰ্কদ্বারা যুক্তিদ্বারা ক্রমশ খণ্ড খণ্ড আকারে মনের মধ্যে কিয়দংশে প্রমাণিত হইতে পারে, কিন্তু তর্কযুক্তি তাহাকে হৃদয়ের মধ্যে সর্বাংশে সঞ্চারিত করিয়া দিতে পারে না । বঙ্কিম গ্রন্থের প্রারম্ভ হইতেই তরবারি হন্তে সংগ্ৰাম করিতে করিতে অগ্রসর হইয়াছেন ; কোথাও । শান্তভাবে তাহার কৃষ্ণের সমগ্র মূর্তি আমাদের সম্মুখে একত্র ধরিবার অবসর পান নাই। সেজন্য তঁহাকে দোষ দেওয়াও যায় না। কারণ, ভক্তসম্প্রদায়ের বাহিরে, এমনকি, ভিতরেও,