পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

¢ዒ8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অসম্ভব-চিত্রিত-পক্ষী-খচিত শ্বেতপ্রস্তররচিত কক্ষপ্রাচীরমধ্যে পুরু গালিচায় বসিয়া রঙ্গসঙ্গিনীগণের হাসিটিট্রিকারিপারিবৃত হইয়া আলবােলায় তামাকু টানিত, সেই পুষ্পপ্রতিমা সুকুমার সুন্দর বালিকাটুকুর মধ্যে কী এক দুর্বাের দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তি জাগ্রত হইয়া উঠিল- সে আজ বাধমুক্ত বন্যার একটি গর্বেদ্ধত প্ৰবল তরঙ্গের ন্যায় দিল্লির সিংহাসনে গিয়া আঘাত করিল । কোথায় ছিল মোগল-রাজপ্ৰসাদের রত্নখচিত রঙমহলে সুন্দরী জেবউন্নিসা- সে সুখের উপর সুখ, বিলাসের উপর বিলাস বিকীর্ণ করিয়া আপনার অন্তরাত্মাকে আরামের পুস্পরাশির মধ্যে আচ্ছন্ন অচেতন করিয়া রাখিয়াছিল- সেদিনের সেই মৃত্যুদোলায় হঠাৎ তাহার অন্তরশয্যা হইতে জাগ্রত হইয়া তাহাকে কোন মহাপ্ৰাণী এমন নিষ্ঠুর কঠিন বাহুবেষ্টনে পীড়ন করিয়া ধরিল, সম্রাট্রদুহিতাকে কে সেই সর্বত্রগামী দুঃখের হন্তে সমর্পণ করিল যে দুঃখ প্রাসাদের রাজরাজেশ্বরীকেও কুটিরবাসিনী কৃষককন্যার সহিত এক বেদনাশয্যায় শয়ন করাইয়া দেয় ! দস্য মানিকলাল হইল বীর, রূপমুগ্ধ মোবারক মৃত্যুসাগরে আত্মবিসর্জন করিল, গৃহপিঞ্জরের নির্মলকুমারী বিপ্লবের বহিরাকাশে উড়িয়া আসিল এবং নৃত্যকুশলা পতঙ্গচপলা, দরিয়া সহসা অট্টহাস্যে মুক্তকেশে কালনৃত্যে আসিয়া যোগ দিল । অর্ধারাত্রির এই বিশ্বব্যাপী ভয়ংকর জাগরণের মধ্যে কি মধ্যাহ্নকুলায়বাসী প্ৰণয়ের করুণ কপোতকৃজন প্রত্যাশা করা যায় ? ‘রাজসিংহ দ্বিতীয় “বিষুবৃক্ষ' হয় নাই বলিয়া আক্ষেপ করা সাজে না। 'বিষবৃক্ষের সুতীব্র সুখদুঃখের পাকিগুলা প্রথম হইতেই পাঠকের মনে কাটিয়া কাটিয়া বসিতেছিল ; অবশেষে শেষ কয়টা পাকে হতভাগ্য পাঠকের একেবারে কণ্ঠরুদ্ধ হইয়া আসে। ‘রাজসিংহের প্রথম দিকের পরিচ্ছেদগুলি মনের উপর সেরূপ রক্তবর্ণ সুগভীর চিহ্ন দিয়া যায় না। তাহার কারণ ‘রাজসিংহ স্বতন্ত্রজাতীয় উপন্যাস । প্ৰবন্ধ লিখিতে বসিয়াছি বলিয়াই মিথ্যা কথা বলিবার আবশ্যক দেখি না । কাল্পনিক পাঠক খাড়া করিয়া তাহদের প্রতি দোষারোপ করা আমার উচিত হয় না। আসল কথা এই যে, রাজসিংহ পড়া আরম্ভ করিয়া আমারই মনে প্রথম-প্রথম খটকা লাগিতেছিল । আমি ভাবিতেছিলাম, বড়োই বেশি তাড়াতাড়ি দেখিতেছি- কাহারও যেন মিষ্টমুখে দুটাে ভদ্রতার কথা বলিয়া যাইবারও অবসর নাই। মনের ভিতর এমন আঁচড় দিয়া না গিয়া আর-একটু গভীরতররূপে কৰ্ষণ করিয়া গেলে ভালো হইত। যখন এই সকল কথা ভাবিতেছিলাম তখন “রাজসিংহের ভিতরে গিয়া প্ৰবেশ করি নাই । পর্বত হইতে প্ৰথম বাহির হইয়া যখন নিঝরিগুলা পাগলের মতো ছুটিতে আরম্ভ করে তখন মনে হয় তাহারা খেলা করিতে বাহির হইয়াছে, মনে হয় না। তাহারা কোনো কাজের। পৃথিবীতেও তাহারা গভীর চিহ্ন অঙ্কিত করিতে পারে না। কিছুদূর তাঁহাদের পশ্চাতে অনুসরণ করিলে দেখা যায় নির্বরগুলা নদী হইতেছে- ক্রমেই গভীরতর হইয়া ক্রমেই প্রশস্ততর হইয়া পর্বত ভাঙিয়া পথ কাটিয়া জয়ধ্বনি করিয়া মহাবলে অগ্রসর হইতেছে- সমুদ্রের মধ্যে মহাপরিণাম প্রাপ্ত হইবার পূর্বে তাহার আর বিশ্রাম নাই । ‘রাজসিংহেও তাই। তাহার এক-একটি খণ্ড এক-একটি নিবারের মতো দ্রুত ছুটিয়া চলিয়াছে। প্রথম-প্ৰথম তাহাতে কেবল আলোকের বিকিঝিকি এবং চঞ্চল লহরীর তরল কলধ্বনি- তাহার পর ষষ্ঠ খণ্ডে দেখি ধ্বনি গভীর, স্রোতের পথ গভীর এবং জলের বর্ণ ঘনকৃষ্ণ হইয়া আসিতেছে, তাহার পর সপ্তম খণ্ডে দেখি কতক-বা নদীর স্রোত, কতক-বা সমুদ্রের তরঙ্গ, কতক-বা অমোঘ পরিণামের মেঘগম্ভীর গর্জন, কতক-বা তীব্র লবণাশ্রুনিমগ্ন হৃদয়ের সুগভীর ক্ৰন্দনোচ্ছিাস, কতক বা কালপুরুষালিখিত ইতিহাসের অব্যাকুল বিরাট বিস্তার, কতক-বা ব্যক্তিবিশেষের মজমান তরণীর প্রাণপণ হাহাধ্বনি। সেখানে নৃত্য অতিশয় রুদ্র, ক্ৰন্দন অতিশয় তীব্র এবং ঘটনাবলী ভারত-ইতিহাসের একটি যুগাবসান হইতে যুগান্তরের দিকে ব্যাপ্ত হইয়া গিয়াছে। ‘রাজসিংহ ঐতিহাসিক উপন্যাস । ইহার নায়ক কে কে ? ঐতিহাসিক অংশের নায়ক ঔরংজেব, রাজসিংহ এবং বিধাতাপুরুষ-উপন্যাস-অংশের নায়ক আছে কি না জানি না, নায়িকা জেবাউন্নিসাঁ ।