পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য f (ሱዒዕ মেঘদুদিন রথযাত্রার দিনে ভারত-ইতিহাসের রথরজজু আকর্ষণ করিয়া দুৰ্গম বন্ধুর পথে চলিয়াছিল। তাহদের মধ্যে অনেকে লেখকের কল্পনাপ্রসূত হইতে পারে তথাপি তাহারা এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের ঐতিহাসিক অংশেরই অন্তর্গত। তাঁহাদের জীবন-ইতিহাসের, তাহাদের সুখদুঃখের স্বতন্ত্র মূল্য নাই- অর্থাৎ এ গ্রন্থে প্রকাশ পায় নাই। জেবউন্নিসার সহিত ইতিহাসের যোগ আছে বটে, কিন্তু সে যোগ গৌণভাবে । সে যোগটুকু না থাকিলে এ গ্রন্থের মধ্যে তাহার কোনো অধিকার থাকিত না । যোগ আছে কিন্তু বিপুল। ইতিহাস তাহাকে গ্ৰাস করিয়া আপনার অংশীভূত করিয়া লয় নাই, সে আপনার জীবন-কাহিনী লইয়া স্বতন্ত্রভাবে দীপ্যমান হইয়া উঠিয়াছে। সাধারণ ইতিহাসের একটা গৌরব আছে। কিন্তু স্বতন্ত্র মানবজীবনের মহিমাও তদপেক্ষা ন্যান নহে । ইতিহাসের উচ্চচুড় রথ চলিয়াছে, বিস্মিত হইয়া দেখো, সমবেত হইয়া মাতিয়া উঠ, কিন্তু সেই রাথচক্ৰতলে যদি একটি মানবহৃদয় পিষ্ট হইয়া ক্ৰন্দন করিয়া মরিয়া যায়। তবে তাহার সেই মর্মান্তিক আৰ্তধ্বনিও, রথের চুড়া যে গগনতল স্পর্শ করিতে স্পর্ধা করিতেছে সেই গগনপথে উচ্ছসিত হইয়া উঠে, হয়তো সেই রথচূড়া ছাড়াইয়া চলিয়া যায় । : সেই ইতিহাস এবং মানব উভয়কেই একত্ৰ করিয়া এই ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা לואן * তিনি এই বৃহৎ জাতীয়-ইতিহাসের এবং তীব্র মানব-ইতিহাসের পরস্পরের মধ্যে কিয়ৎপরিমাণে ভাবেরও যোগ রাখিয়াছেন । মোগল-সাম্রাজ্য যখন সম্পদে এবং ক্ষমতায় স্ফীত হইয়া একান্ত স্বার্থপর হইয়া উঠিল, যখন সে সম্রাটের পক্ষে ন্যায়পরতা অনাবশ্যক বোধ করিয়া, প্রজার সুখদুঃখে একেবারে অন্ধ হইয়া পড়িল, তখন তাহার জাগরণের দিন উপস্থিত হইল । বিলাসিনী জেবাউন্নিসাও মনে করিয়াছিল সম্রাট্রদুহিতার পক্ষে প্রেমের আবশ্যক নাই, সুখই একমাত্র শরণ্য। সেই সুখে অন্ধ হইয়া যখন সে দয়া ধর্মের মস্তকে আপন জরিজহরতজড়িত পাদুকাখচিত সুন্দর বামচরণখনি দিয়া পদাঘাত করিল। তখন কোন অজ্ঞাত গুহাতল হইতে কুপিত প্ৰেম জাগ্রত হইয়া তাহার মর্মস্থলে দংশন করিল, শিরায় শিরায় সুখমন্থরগামী রক্তস্রোতের মধ্যে একেবারে আগুন বহিতে লাগিল, আরামের পুষ্পশয্যা,চিতাশয্যার মতো তাহাকে দগ্ধ করিল— তখন সে ছুটিয়া বাহির হইয়া উপেক্ষিত প্রেমের কণ্ঠে বিনীত দীনভাবে সমস্ত সুখসম্পদের বরমাল্য সমর্পণ করিল- দুঃখকে স্বেচ্ছায় বরণ করিয়া হৃদয়াসনে অভিষেক করিল। তাহার পরে আর সুখ পাইল না, কিন্তু আপন তীব্র যন্ত্রণার পর ধুলায় ভূমিষ্ঠ হইয়া উদার জগতীতলে জন্মগ্রহণ করিল। এখন হইতে সে অনন্ত জগৎবাসিনী রমণী । ইতিহাসের মহাকোলাহলের মধ্যে এই নবজাগ্রত হতভাগিনী নারীর বিদীর্ণপ্ৰায় হৃদয় মাঝে মাঝে ফুলিয়া ফুলিয়া কাদিয়া কঁাদিয়া উঠিয়া রাজসিংহের পরিণাম অংশে বড়ো-একটা রোমাঞ্চকর সুবিশাল করুণা ও ব্যাকুলত বিস্তার করিয়া দিয়াছে। দুর্যোগের রাত্রে এক দিকে মোগলের অভ্ৰভেদী পাষাণপ্রাসাদ ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে, আর-এক দিকে সর্বত্যাগিনী রমণীর অব্যক্ত ক্ৰন্দন ফাটিয়া ফাটিয়া উঠিতেছে ; সেই বৃহৎ ব্যাপারের মধ্যে কে তাহার প্রতি দৃকপাত করিবে- কেবল যিনি ধূলিলুণ্ঠ্যমান ক্ষুদ্র মানবীকেও অনিমেষ লোচনে নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। এই ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাধিয়া সংযত *মিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হৃদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে ইয়াছে- কেহ কাহারও অগ্রবতী না হয়, এ বিষয়ে গ্রন্থকারের বিশেষ লক্ষ ছিল দেখা যায়। লেখক যদি উপন্যাসের পাত্ৰগণের সুখদুঃখ এবং হৃদয়ের লীলা বিস্তার করিয়া দেখাইতে বসিতেন তবে