পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(፩brbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী কাব্যে যে নয় রস আছে, অনেক কবিই সেই ঈর্ষান্বিত নয়। রসকে নয় মহলে পৃথক করিয়া রাখেন— দ্বিজেন্দ্রলালবাবু অকুতোভয়ে এক মহলেই একত্র তাহাদের উৎসব জমাইতে বসিয়াছেন । র্তাহার কাব্যে হাস্য, করুণা, মাধুর্য, বিস্ময়, কখন কে কাহার গায়ে আসিয়া পড়িতেছে, তাহার ঠিকানা क्राष्ट्रि | এইরূপে ‘মন্দ্র কাব্যের প্রায় প্রত্যেক কবিতা নব নব গতিভঙ্গে যেন নৃত্য করিতেছে, কেহ স্থির হইয়া নাই ; ভাবের অভাবনীয় আবর্তনে তাহার ছন্দ ঝংকৃত হইয়া উঠিতেছে এবং তাহার অলংকারগুলি হইতে আলোক ঠিকারিয়া পড়িতেছে। কিন্তু নর্তনশীলা নটীর সঙ্গে তুলনা করিলে “মন্দ্র কাব্যের কবিতাগুলির ঠিক বর্ণনা হয় না। কারণ ইহার কবিতাগুলির মধ্যে পৌরুষ আছে। ইহার হাস্য, বিষাদ, বিদ্যুপ, বিস্ময় সমস্তই পুরুষের— তাহাতে চেষ্টহীন সৌন্দর্যের সঙ্গে একটা স্বাভাবিক সবলতা আছে । তাহাতে হাবভাব ও সাজসজার প্ৰতি কোনো নজর নাই । বরং উপমা দিতে হইলে শ্রাবণের পূর্ণিমারাত্রির কথা পাড়া যাইতে পারে। আলোক এবং অন্ধকার, গতি এবং স্তব্ধতা, মাধুর্য ও বিরাটভােব আকাশ জুড়িয়া অনায়াসে মিলিত হইয়াছে। আবার মাঝে মাঝে এক-এক পসিলা বৃষ্টিও বাতাসকে আদ্ৰ করিয়া ঝরঝর শব্দে ঝরিয়া পড়ে। মেঘেরও বিচিত্র ভঙ্গিতাহা কখনো চাদকে অর্ধেক ঢাকিতেছে, কখনো পুরা ঢাকিতেছে, কখনো-বা হঠাৎ একেবারে মুক্ত করিয়া দিতেছে- কখনো-বা ঘোরাঘটায় বিদ্যুতে স্কুরিত ও গর্জনে স্তনিত হইয়া উঠিতেছে। দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলাভাষার একটা নূতন শক্তি আবিষ্কার করিয়াছেন। প্রতিভাসম্পন্ন লেখকের সেই কাজ । ভাষাবিশেষের মধ্যে যে কতটা ক্ষমতা আছে, তাহাৰ্তাহারাই দেখাইয়া দেন-পূর্বে যাহার অস্তিত্ব কেহ সন্দেহ করে নাই, তাহাই তাহারা প্রমাণ করিয়া দেন। দ্বিজেন্দ্রলালবাবু বাংলা কাব্যভাষার একটি বিশেষ শক্তি দেখাইয়া দিলেন । তাহা ইহার গতিশক্তি । ইহা যে কেমন দ্রুতবেগে, কেমন অনায়াসে তরল হইতে গভীর ভাষায়, ভাব হইতে ভাবান্তরে চলিতে পারে, ইহার গতি যে কেবলমাত্র মৃদুমন্থর আবেশভারাক্রান্ত নহে, তাহা কবি দেখাইয়াছেন । ছন্দ সম্বন্ধেও যেন স্পর্ধাভরে কবি যথেচ্ছ ক্ষমতা প্ৰকাশ করিয়াছেন । তাহার “আশীর্বাদ ও “উদ্বোধন কবিতায় ছন্দকে একেবারে ভাঙিয়া-চুরিয়া উড়াইয়া দিয়া ছন্দেরচনা করা হইয়াছে। তিনি যেন সাংঘাতিক সংকটের পাশ দিয়া গেছেন- কোথাও যে কিছু বিপদ ঘটে নাই, তাহা বলিতে পারি না । কিন্তু এই দুঃসাহস কোনো ক্ষমতাহীন কবিকে আন্দীে শোভা পাইত না । এইবার নমুনা উদধূত করিবার সময় আসিয়াছে। কিন্তু আমরা ফুল ছিড়িয়া বাগানের শোভা বুকু জুপুরি না। পাঠকগণ কাব্য পড়িকাে— কেবল সমালােচনা চাৰিয়া ভােজের পূর্ণ नष्ठे না | কার্তিক ১৩০৯ শুভবিবাহ রাস্কিন এক জায়গায় বলিয়াছেন, মহৎ আর্ট মাত্রই স্তব । সেইসঙ্গেই র্তাহাকে বলিতে হইয়াছে, কোনো বড়ো জিনিসকে সংজ্ঞার দ্বারা বাধা সহজ নহে- অতএব, আর্ট ব্যাপারটা যে স্তব, সেটা খোলস। করিয়া বোঝানো আবশ্যক । মানুষ বিশ্বসংসারে যাহা ভালোবাসে, আর্টের দ্বারা তাহার স্তব করে। সুন্দর গড়ন দিয়া মানুষ যখন একটা সামান্য ঘট প্রস্তুত করে, তখন সে কী করে ? না, রেখার যে মনোহর রহস্য আমরা ফুলের * পাপড়ির মধ্যে, ফলের পূর্ণতার মধ্যে, পাতার ভঙ্গিমায়, জীবশরীরের লবণ্যে দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছি, মানুষ ঘটের গঠনে বিশ্বের সেই রেখাবিন্যাস-চাতুরীর প্রশংসা করে। বলে যে, জগতে চোখ মেলিয়া এই সকল বিচিত্র সুষম আমার ভালো লাগিয়াছে।