পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য ○br> এইখানে একটা কথা ভাবিবার আছে। বিশ্বপ্রকৃতি বা মানবপ্রকৃতির মধ্যে যাহা-কিছু মহৎ বা সুন্দর, তাহাই আমাদের স্তবের যোগ্য, সুতরাং তাঁহাই আর্টের বিষয়, এ কথা বলিলে সমস্ত কথা বলা হয় না । প্ৰাণের প্রতি প্ৰাণের, মনের প্রতি মনের, হৃদয়ের প্রতি হৃদয়ের একটা স্বাভাবিক টান আছে ইহাকে বিশেষভাবে সৌন্দর্য বা ঔদার্যের আকর্ষণ বলিতে পারি না । ইহাকে ঐক্যের আকর্ষণ বলা যাইতে পারে। আমি মানুষ, কেবল এইজন্যই মানুষের সকল বিষয়েই আমার মনের একটা ঔৎসুক্য আছে। আমি বাঙালি, এইজন্য বাঙালির তুচ্ছ বিষয়টিতেও আমার মনের মধ্যে একটা সাড়া পাওয়া যায়। গ্রামের দিঘির ভাঙা ঘাটটি আমার ভালো লাগে— সুন্দর বলিয়া নয়, গ্রামকে ভালোবাসি বলিয়া । । গ্রামকে কেন ভালোবাসি ? না, গ্রামের লোকজনদের প্রতি আমার মনের একটা টান আছে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা যে রামচন্দ্ৰ-যুধিষ্ঠির, সীতা-সাবিত্রীর দল, তাহা নহে- তাহারা নিতান্তই সাধারণ লোক- তাহদের মধ্যে স্তব করিবার যোগ্য কোনো বিশেষত্বই দেখা যায় না । যদি কোনো কবি এই ঘাটটির প্রতি র্তাহার অনুরাগ ঠিকমত ব্যক্ত করিয়া কবিতা লিখিতে পারেন, তবে সে কবিতা কেবল যে এই গ্রামের লোকেরই মনে লাগিবে, তাহা নহে- সকল দেশেরই সহৃদয় পাঠক এই কবিতার রস উপভোগ করিতে পরিবে । কারণ, যে-ভাবটি লইয়া এই কবিতা রচিত, তাহা সকল দেশের মানুষের পক্ষেই সমান । এ কথা সত্য যে, অনেক আর্টই, যাহা উদার, যাহা সুন্দর, তাহার প্রতি আমাদের ভক্তি বা প্রীতির প্রকাশ । কিন্তু যাহা সুন্দর নহে, যাহা সাধারণ, তাহার প্রতি আমাদের মনের সহজ আনন্দ, ইহাও আর্টের বিষয় । যদি তাহা না হইত, তবে আর্ট আমাদের ক্ষতিই করিত । কারণ, কেবলমাত্র বাছাই করিয়া জগতের যাহা-কিছু বিশেষভাবে সুন্দর বিশেষভাবে মহৎ, তাহারই প্রতি আমাদের রুচিকে বারংবার প্রবর্তিত করিতে থাকিলে আমাদের একটা রসের বিলাসিত জন্মায় । যাহা প্ৰতিদিনের, যাহা চারি দিকের, যাহা হাতের কাছে আছে, তাহা আমাদের কাছে বিস্বাদ হইয়া আসে ; ইহাতে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে আমাদের অনুভবশক্তির আতিশয্য ঘটাইয়া আর সর্বত্র তাহার জড়ত্ব উৎপাদন করা হয়। এইরূপ আর্ট-সম্বন্ধীয় বাবুয়ানার দুৰ্গতির কথা টেনিসন তাহার কোনাে কাব্যে বর্ণনা করিয়াছেন, সকলেই তাহা জানেন । আমরা যে-গ্ৰন্থখানির সমালোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, পাঠকের সহিত তাহার পরিচয়সাধন করাইবার | আরম্ভে ভূমিকাস্বরূপ উপরের কয়েকটি কথা বলা গেল । রাস্কিনের সংজ্ঞা অনুসারে ‘শুভবিবাহ’ বইখানি কিসের স্তব ? ইহার মধ্যে সৌন্দর্যের ছবি, মহন্ধের আদর্শ, কী প্ৰকাশ পাইয়াছে ? ইহার উত্তরে বলিব, এমন করিয়া হিসাব খাতাইয়া দেখা চলে না । আপিস হইতে ফিরিয়া আসিলে ঘরের লোক জিজ্ঞাসা করিতে পারে, আজ তুমি কী রোজগার করিয়া আনিলে ? লাভের পরিমাণ তখনই তাহাকে গুনিয়া দেখানো যাইতে পারে। কিন্তু বন্ধুবান্ধবের বাড়ি ঘুরিয়া আসিলে যদি প্রশ্ন ওঠে, আজ তুমি কী লাভ করিলে, তবে থলি ঝাড়িয়া তাহা হাতে-হাতে দেখানো সম্ভবপর হইতে পারে না । সাহিত্যেও কোনাে কোনাে বিশেষ গ্রন্থে কী পাওয়া গেল, তাহা বেশ স্পষ্ট করিয়া দেখানো যাইতে পারে । কিন্তু এমন গ্ৰন্থও আছে, যাহার লাভ অমন করিয়া হিসাবের মধ্যে আনা যায় না- যাহা নূতন শিক্ষা নহে, যাহা মহান উপদেশ নহে, যাহা অপরূপ সৃষ্টি নহে। যাহা কেবল পরিচিতের সঙ্গে পরিচয়, আলােপীর সঙ্গে আলাপ, বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বমাত্র। কিন্তু জীবনের আনন্দের অধিকাংশই এইরূপ অত্যন্ত সহজ এবং সামান্য জিনিস লইয়াই তৈরি। আকস্মিক, অদ্ভুত, অপূর্ব আমাদের জীবনের পথে দৈবাৎ আসিয়া জোটে ; তাহার জন্য যে বসিয়া থাকে বা খুঁজিয়া বেড়ায় তাহাকে প্রায়ই বঞ্চিত হইতে হয়। - "শুভবিবাহ একটি গল্পের বই, স্ত্রীলোকের লেখা, ইহার গল্পের ক্ষেত্রটি কলিকতা কায়স্থসমাজের আন্তঃপুর । এটুকু বলিতে পারি, মেয়ের কথা মেয়েতে যেমন করিয়া লিখিয়াছে, এমন কোনো পুরুষ-গ্ৰন্থকার লিখিতে পারিত না ।