পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (SW অপাপের অমন্দের একটি নিজীব সুবৃহৎ সমতল নিশ্চলতা শ্রেয় ! শেষের দিকেই আমাদের অন্তরের আকর্ষণ- কারণ, বিরাট সংগ্রামের উপযোগী বল আমরা অন্তঃকরণের মধ্যে অনুভব করি না, ধর্ম এবং অর্থ, কাম এবং মোক্ষ এই সাব-কটাকে একত্র চালনা করিবার মতো উদ্যম আমাদের নাইআমরা সর্বপ্রকার দুরন্ত চেষ্টাকে নিবৃত্ত করিয়া সম্পূর্ণ শান্তিলাভ করিবার প্রয়াসী । কিন্তু শাস্ত্রে যখন ভারতবর্ষকে দুর্গপ্রাচীরের মতো রক্ষা করিতে পারে না, পরজাতির সংঘাত যখন অনিবাৰ্য, যখন লোভের নিকট হইতে স্বার্থরক্ষা এবং হিংসার নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিতে আমরা বাধ্য, তখন মানবের মধ্যে যে-দানবটা আছে, সেটাকে সকালে সন্ধ্যায় আমিষ খাওয়াইয়া কিছু না হউক দ্বারের বাহিরেও প্রহরীর মতো বসাইয়া রাখা সংগত। তাহাতে আর কিছু না হউক, বলশালী লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে । কিন্তু হায়, ভারতবর্ষে দেব-দানবের যুদ্ধে দানবগুলো একেবারেই গেছে- দেবতারাও যে খুব সজীব আছেন, তাহা বোধ হয় না । অন্তত সর্বপ্রকার শঙ্কা ও দ্বন্দ্ব -শুন্য হইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন । শ্রাবণ ১৩০৫ সিরাজদ্দৌলা শ্ৰীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয় -প্ৰণীত স্কুলে যাঁহাদিগকে ইতিহাস মুখস্থ করিতে হইয়াছে তঁহাদের সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে, ভারত-ইতিবৃত্তে ইংরাজ-শাসনকালের বিবরণ সর্বাপেক্ষা নীরস । তাহার একটা কারণ, এই বিবরণে মানবস্বভাবের লীলা পরিস্ফুট দেখা যায় না। গবর্নর আসিলেন, যুদ্ধ হইল, জয়পরাজয় হইল, পাচ বৎসর কাটিয়া গেল, গবর্নর চলিয়া গেলেন । է: অবশ্য ব্যাপারটা সত্যই এমন সম্পূর্ণ হৃদয়সম্পর্কশূন্য কলের কাণ্ড নহে। ভারতশতরঞ্চমঞ্চে সাদা ও কালো ঘরে নানা পক্ষে যে-সকল বিচিত্র চাল চালিতেছিলেন, তাহার মধ্যে ভুলভ্রান্তিরাগদ্বেষ-লোভামোহের হাত ছিল না। এমন নহে। কিন্তু রাজভক্তি ও পাঠ্যসমিতির প্রতি লক্ষ রাখিয়া লেখকদিগকে সংকীর্ণ সীমায় সভায় পদক্ষেপ করিতে হয়। সেইজন্য অন্তত বাংলায় রচিত ইতিহাসে ইংরাজশাসনের অধ্যায় অত্যন্ত শুষ্ক এবং শীর্ণ। আরো একটা কথা আছে । মোগল-পাঠানের সময় প্রত্যেক সম্রাট স্বতন্ত্র প্রভুরূপে স্বেচ্ছামতে রাজ্যশাসন করিতেন, সুতরাং তঁহাদের স্বাধীন ইচ্ছার আন্দােলনে ভারত-ইতিবৃত্তে পদে পদে রসবৈচিত্র্য তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু ইংরাজের ভারতবর্ষে ইংলন্ডের রাজতন্ত্রের শাসন। তাহার মধ্যে হৃদয়ের লীলা অত্যন্ত গীেণ ব্যাপার। মানুষ নাই, রাজা নাই, কেবল একটা পলিসি অতি দীর্ঘ পথ দিয়া ডাক বসাইয়া চলিয়াছে, প্রতি পাঁচ বৎসর অন্তর তাহার বাহক বদল হয় মাত্র । সেই পলিসি কিরূপ সূক্ষ্ম জটিল সুদূরব্যাপী, এই মাকড়সাজালের সূত্রগুলি জিব্রুস্টার ইজিপ্ট এডেন প্রভৃতি দেশদেশান্তর হইতে লম্বমান হইয়া কেমন করিয়া ভারতবর্ষকে আপাদমস্তক ছাকিয়া ধরিয়াছে তাহার বিবরণ আমাদের পক্ষে কৌতুকাবহ সন্দেহ নাই এবং সেই বিবরণ লায়াল সাহেবের ভারতসাম্রাজ্য গ্রন্থে যেমন সংক্ষেপে ও মনােরম আকারে বিবৃত হইয়াছে এমন আর-কোথাও দেখি নাই । কিন্তু এই বিবরণ মানববুদ্ধির নৈপূণ্যব্যঞ্জক ঐতিহাসিক যন্ত্রতত্ত্ব— তাহা পাঠকের চিরকৌতুকাবহ ঐতিহাসিক হৃদয়তত্ত্ব নহে। পশ্চিমদেশের কল পূর্বদেশে কিরূপ পুতুলীবাজি করাইতেছে তাহার মধ্যে কিঞ্চিৎ হাস্যরস কিঞ্চিৎ করুণরস এবং প্রভূত পরিমাণে বিস্ময়রস আছে, কিন্তু প্রত্যক্ষ হৃদয়ের সহিত হৃদয়ের সংঘর্ষে যে নাট্যরসভূয়িষ্ঠ সাহিত্যের উপাদান জন্মে ইহাতে তাহা স্বল্প । ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে সেই ঐতিহাসিক উপন্যাস রস, ইংরাজিতে যাহাকে রোম্যান্স বলে