পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(8 রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। তখন ইংরাজের স্বাভাবিক দূরদশী রাজ্যবিস্তারনীতির মধ্যেও ব্যক্তিগত স্বাৰ্থলোভ রাগদ্বেষের লীলায় ইতিহাসকে চঞ্চল ও উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছিল। শ্ৰীযুক্ত বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয় তাহার ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থে ঐতিহাসিক রহস্যের যেখানে যবনিকা উত্তোলন করিয়াছেন সেখানে মোগল-সাম্রাজ্যের পতনোমুখ প্রাসাদদ্বারে ইংরাজ বণিকসম্প্রদায় অত্যন্ত দীনভাবে দণ্ডায়মান । তখন ভারতক্ষেত্রে সংহারশক্তি যতপ্রকার বিচিত্র বেশে সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল তন্মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাধু শান্ত ও দরিদ্র বেশ ছিল ইংরাজের। মারাঠি অশ্বপুষ্ঠে দিগদিগন্তরে কালানল জ্বালাইয়া ফিরিতেছিল, শিখ ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে আপন দুৰ্জয় শক্তিকে পুঞ্জীভূত করিয়া তুলিতেছিল, মোগল-সম্রাটের রাজপ্রতিনিধিগণ সেই-যুগান্তরের সন্ধ্যাকাশে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্রোহের রক্তধ্বজা আন্দোলন করিতেছিল, কেবল কয়েকজন ইংরাজী সওদাগর বাণিজ্যের বস্তা মাথায় করিয়া সম্রাটের প্রাসাদসোপানে প্ৰসাদচ্ছায়ায় অত্যন্ত বিনম্রভাবে আশ্রয় লইয়াছিল । মাতামহ আলিবন্দির ক্ৰোড়ে নবাব-রাজহর্ম্যে সিরাজদ্দৌলা যখন শিশু, তখন ভাবী ইংরাজ-রাজমহিমাও কলিকাতায় সওদাগরের কুঠিতে ভূমিষ্ঠ হইয়া অসহায় শিশুলীলা যাপন করিতেছিল। উভয়ের মধ্যে একটি অদৃষ্ট বন্ধন বঁাধিয়া দিয়া ভবিতব্য আপন নিদারুণ কৌতুক গোপন করিয়া রাখিয়াছিল । প্রমোদের মোহমত্ততায় এই প্ৰলয়নাট্যের আরম্ভ হইল। ভাগীরথীতটো হীরাঝিলের নিকুঞ্জবনে বিলাসিনীর কলকণ্ঠ এবং নর্তকীর নূপুরধ্বনি মুখরিত হইয়া উঠিল। লালসার লুব্ধহস্ত গৃহস্থের রুদ্ধগৃহের মধ্যেও প্রসারিত হইল। এ দিকে নেপথ্যে মাঝে মাঝে বর্গিদলের অশ্বখুরধ্বনি শুনা যায়, অস্ত্রঝঞ্ছনা বাজিয়া উঠে। তাহাদের আক্রমণ ঠেকাইবার জন্য বৃদ্ধ আলিবর্দি দশ দিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিলেন। এই উৎপাতের সুযোগে ইংরাজ বণিক কাশিমবাজারে একটি দুৰ্গ ফাদিল এবং স্থানে স্থানে আত্মরক্ষার উপযোগী সৈন্য সমাবেশ করিতে লাগিল । । ሳ' বণিকদের স্পর্ধাও বাড়িতে লাগিল। তাহারা দেশী-বিদেশী মহাজনাদিগের নীেক জাহাজ লুঠতরাজ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। কোম্পানির কর্মচারিগণ আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবসহ বিনাশুন্ধে নিজ হিসাবে বাণিজ্য চালাইতে প্ৰবৃত্ত হইল । এমন সময়ে সিরাজদ্দৌলা যৌবরাজ্য গ্ৰহণ করিলেন এবং ইংরাজের স্বেচ্ছাচারিতা দমন করিবার জন্য কঠিন শাসন বিস্তার করিলেন । রাজমর্যাদাভিমানী নবাবের সহিত ধনলোলুপ বিদেশী বণিকের দ্বন্দ্ব বাধিয়া উঠিল। এই দ্বন্দ্বে বণিক-পক্ষে গৌরবের বিষয় কিছুই নাই। সিরাজদ্দৌলা যদিচ উন্নতচরিত্র মহৎ ব্যক্তি ছিলেন না, তথাপি এই দ্বন্দ্বের হীনতা-মিথ্যাচার প্রতারণার উপরে তঁহার সাহস ও সরলতা, বীর্য ও ক্ষমা রাজ্যোচিত মহত্ত্বে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। তাই ম্যালিসন তাহার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন, “সেই পরিণামদারুণ মহানাটকের প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে সিরাজদ্দৌলাই একমাত্র লোক যিনি প্রতারণা করিবার চেষ্টা করেন নাই ।” দ্বন্দ্বের আরম্ভটি পত্রযুগল সমন্বিত তরুর অন্ধুরের ন্যায় ক্ষুদ্র ও সরল, কিন্তু ক্রমশ নানা লোক ও নানা মতলবের সমাবেশ হইয়া তাহা বৃহৎ বনস্পতির ন্যায় বিস্তৃত ও জটিল হইয়া পড়িল । নিপুণ সারথি যেমন এককালে বহু অশ্ব যোজনা করিয়া রথচালনা করিতে পারে, অক্ষয়বাবু তেমনি প্রতিভাবলে এই বহুনায়কসংকুল জটিল দ্বন্দ্ববিবরণকে আরম্ভ হইতে পরিণাম পর্যন্ত সবলে অনিবাৰ্যবেগে ছুটাইয়া লইয়া গিয়াছেন। র্তাহার ভাষা যেরূপ উজ্জ্বল ও সরস, ঘটনাবিন্যাসও সেইরূপ সুসংগত, প্রমাণ-বিশ্লেষণও সেইরূপ সুনিপুণ। যেখানে ঘটনাসকল বিচিত্র এবং নানাভিমুখী, প্রমণসকল বিক্ষিপ্ত এবং পদে পদে তুর্কবিচারের অবতারণা আবশ্যক হইয়া পড়ে, সেখানে বিষয়টির সমগ্ৰতা সর্বত্র রক্ষা করিয়া তাহাকে ক্ষিপ্ৰগতিতে বহন করিয়া লইয়া যাওয়া ক্ষমতাশালী লেখকের কাজ। বিশেষত প্রমাণের বিচারে গল্পের