পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(SV2 রবীন্দ্র-রচনাবলী ইংরাজ আমাদের ক্ষমতাশালী প্ৰভু। সেই ক্ষমতা ও প্রভাবের প্রত্যক্ষ আকর্ষণ অত্যন্ত অধিক । এত অধিক যে, অন্যায় ও অত্যাচারও যদি ঘটে তথাপি তাহা দুর্বল ব্যক্তিদিগকে ভয়ে বিস্ময়ে এবং একপ্রকার অন্ধ আসক্তিতে অভিভূত করিয়া রাখে । অতএব দেড়শত বৎসর পূর্বে ইংরাজ বণিক তৎকালীন রাজস্থানীয়দের প্রতি কিরূপ আচরণ করিয়াছিল তাহা পাঠ করিয়া ইংরাজের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করিতে থাকিবে এমন ভারতবাসী নাই। মুখে যাহাই বলি, কোনোদিন বিশেষ আঘাতের ক্ষোভে বিশেষ কারণে যেমনই তর্ক করি, ইংরাজের প্রবল প্ৰতাপের আকর্ষণ ছেদন করা আমাদের পক্ষে সহজ নহে । অতএব যতদিন আমরা দুর্বল এবং ইংরাজ সবল ততদিন আমাদের মুখের নিন্দায় তাহাদের ক্ষতি নাই বলিলেই হয়, তঁহাদের মুখের নিন্দ আমাদের পক্ষে সাংঘাতিক । ততদিন আমাদের সংবাদপত্র কেবল তঁহাদের ও তঁহদের মেমসাহেবদের কৰ্ণপীড়া উৎপাদন করে মাত্র এবং তঁহাদের সংবাদপত্র আমাদের মর্মস্থানের উপর বন্দুকের গুলি বর্ষণ করে । কিন্তু ইংরাজি সাহিত্যে একটা অন্যায় আচরিত হয় বলিয়া আমরা তাহার অন্যায় প্রতিশোধ লাইব ইহা সুযুক্তির কথা নহে- বিশেষত দুর্বলের পক্ষে সবলের অনুকরণ ভয়াবহ । ইংরাজের অন্যায় নিন্দা ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্রন্থের উদ্দেশ্য নহে। তবে, এমন-একটা প্রসঙ্গের উত্থাপন করায় কী প্রয়োজন ছিল ! সেই প্রয়োজনীয়তা সমালোচক ঠিকভাবে বুঝিবেন এবং যথার্থভাবে গ্রহণ করিবেন কি না সন্দেহ । ঘাতপ্রতিঘাতের একটা স্বাভাবিক নিয়ম আছে । প্ৰাচ্য চরিত্র, প্রাচ্য শাসননীতি সম্বন্ধে ইংরাজি গ্রন্থে ছোটাে-বড়ো স্পষ্ট-অস্পষ্ট, সংগত-অসংগত অজস্র কটুক্তি পাঠ করিয়া শিক্ষিত-সাধারণের মনে যে-একটা অবমাননাজনিত ক্ষোভ জন্মিতে পারে এ কথা অল্প ইংরাজই কল্পনা করেন । , অথচ, প্রথম শিক্ষাকালে ইংরাজের গ্রন্থ আমরা বেদবাক্যস্বরূপ গ্ৰহণ করিতাম । তাহা আমাদিগকে যতই ব্যথিত করুক তাহার যে প্ৰতিবাদ সম্ভবপর, তাহার যে প্ৰমাণ-আলোচনা আমাদের আয়ত্তগত এ কথা আমাদের বিশ্বাস হইত না । নীরবে নতশিরে। আপনাদের প্রতি ধিক্কার-সহকারে সমস্ত লাঞ্ছনাকে সম্পূর্ণ সত্যজ্ঞানে বহন করিতে হইত। এমন অবস্থায় আমাদের দেশের যে-কোনো কৃতী গুণী ক্ষমতাশালী লেখক সেই মানসিক বন্ধন । ছেদন করিয়াছেন, যিনি আমাদিগকে অন্ধ অনুবৃত্তি হইতে মুক্তিলাভের দৃষ্টান্ত দেখাইতে পারিয়াছেন তাহা ছাড়া প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সংঘর্ষে আমাদের ভাগে যে কেবলই কলঙ্ক সেটা সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করা এবং বিরুদ্ধ প্ৰমাণ আনয়ন করা আমাদের নতশির ক্ষত হৃদয়ের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় । । অক্ষয়বাবু যে অন্ধকূপহত্যার সহিত গ্লেনকোর হত্যাকাণ্ড ও সিপাহিবিদ্রোহকালে অমৃতসরের নিদারুণ নিধন-ব্যাপারের তুলনা করিয়াছেন ইতিহাসবিবৃতিস্থলে তাহা অপ্রাসঙ্গিক হইতে পারে এবং ইংরাজ সমালোচকের তৎপ্রতি ক্রুদ্ধ কটাক্ষপাতও সংগত হইতে পারে, কিন্তু আমরা ইহাকে নিরর্থক বলিতে পারি না । এইজন্য পারি না যে, যে-সকল সমূলক, অমূলক ও অতিরঞ্জিত বিবরণ পাঠ করিয়া প্রাচ্য-চরিত্রের নির্দয় বর্বরতায় ইংরাজ-সন্তানগণ বংশানুক্রমে কণ্টকিত হইয়া আসিতেছেন এবং উচ্চ ধর্মমঞ্চ হইতে আমাদের প্রতি ভৎসনা উদ্যত করিয়া রাখিয়াছেন, অন্ধকূপহত্যা তাহার মধ্যে একটা প্রধান । সেই আঘাতের একটা প্ৰতিঘাত করিতে না পারিলে আত্মবিমাননার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না । সুযোগ বুঝিয়া এ কথা বলিবার প্রলোভন আমরা সংবরণ করিতে পারি না যে, শত্রুর প্রতি অন্ধ হিংস্রতা বিকৃত মানবচরিত্রের পশুপ্রবৃত্তি, তাহা বিশেষরূপে প্রাচ্য-চরিত্রের নহে। সমালোচকের ধর্মমঞ্চ কেবল এক কোনো জাতির নহে। অবসর পাইলে আমরাও তাহার উপর চড়িয়া বিচারক মহাশয়ের কলঙ্ককালিমায় তর্জনী নির্দেশ করিতে পারি। খৃস্টানশাস্ত্রে বলে পরকে বিচার করিলে নিজেকেও বিচারাধীনে আসিতে হয় । স্বীকার করি ইহা ইতিহাসনীতি নহে, কিন্তু ইহা স্বভাবের নিয়ম। অবশ্য ইহাও স্বভাবের নিয়ম যে, সবল দুর্বলকে যেমন স্বচ্ছন্দে নিশ্চিন্তচিত্তে বিচার করিয়া থাকে,