পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (ዮጵዓ দুর্বল সবলকে তেমন করিয়া বিচার করিতে গেলে সবলের ভুযুগল কুটিল এবং মুষ্টিযুগল উদ্যত হইয়া উঠিতে পারে। অক্ষয়বাবু হয়তো আদিম প্রকৃতির। সেই রূঢ় নিয়মের অধীনে আসিয়াছেন। কিন্তু বাংলা ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সেজন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন। সমালোচক মহাশয় এ কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন যে, মুসলমান-রােজ্যাকালে এরূপ গ্ৰন্থ অক্ষয়বাবু লিখিতে পারিতেন না । হয়তো পারিতেন না। মুসলমান-রাজ্যকালে বিজিত হিন্দুগণ প্রধান মন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, রাজস্ব সচিব প্রভৃতি উচ্চতর রাজকাৰ্যে অধিকারবান ছিলেন। কিন্তু কোনো নবাবি আমলে উক্ত নবাবের দেড়শতাব্দ-পূৰ্ববতী ইতিহাস, বাহিরের প্রমাণ ও অন্তরের বিশ্বাস অনুসারে তাহারা হয়তো লিখিতে পারিতেন না । ইংরাজ-রাজত্বকালে অক্ষয়বাবু যদি সেই অধিকার লাভ করিয়া থাকেন তবে তাহা ইংরাজশাসনের গৌরব, কিন্তু তবে কেন সেই অধিকার ব্যবহারের জন্য সমালোচক মহাশয় চক্ষু রক্তবর্ণ করিতেছেন ? এবং যদি সে অধিকার অক্ষয়বাবুর না থাকে, যদি তিনি আইনের মর্যাদা লঙঘন করিয়া থাকেন, তবে কেন সমালোচক মহাশয় অধিকারদানের ঔদার্য লইয়া গৌরব প্ৰকাশ করিতেছেন ? ফলত এই অধিকারের রেখা এতই ক্ষীণ সূক্ষ্ম হইয়া আসিয়াছে যে, র্যাহারা আইনের অনুবীক্ষণ নিপুণভাবে প্রয়োগ করিতে পারেন তাহারাও সীমানির্ণয়ে মতভেদ প্রকাশ করিয়া থাকেন- এমন অবস্থায় অন্তত আরো কিছুদিন এ সম্বন্ধে কোনো কথা না বলাই ভালো । Ko S. Odo ঐতিহাসিক চিত্র আমরা “ঐতিহাসিক চিত্র’ নামক একখানি ঐতিহাসিক পত্রের মুদ্রিত প্রস্তাবনা প্ৰাপ্ত হইয়াছি। শ্ৰীযুক্ত এই প্ৰস্তাবনায় লিখিত হইয়াছে- “আমাদের ইতিহাসের অনেক উপকরণ বিদেশীয় পরিব্রাজকগণের গ্রন্থে লিপিবদ্ধ ; তাহা বহুভাষায় লিখিত বলিয়া আমাদের নিকট অপবিজ্ঞাত ও অনাদৃত। মুসলমান বা ইউরোপীয় সমসাময়িক ইতিহাস লেখকগণ যে-সকল বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন, তাহারও অদ্যাপি বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয় নাই। পুরাতন রাজবংশের কাগজপত্রের মধ্যে যে-সকল ঐতিহাসিক তত্ত্ব লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান লইবারও ব্যবস্থা দেখা যায় না। ‘নানা ভাষায় লিখিত ভারতভ্রমণকাহিনী ও ইতিহাস্যাদি প্রামাণ্য গ্রন্থের অনুবাদ, অনুসন্ধানলব্ধ নবাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্য, আধুনিক ইতিহাস্যাদির সমালোচনা এবং বাঙালি রাজবংশ ও জমিদারবংশের পুরাতত্ত্ব প্রকাশিত করাই (এই প্রস্তাবিত পত্রের) মুখ্য উদ্দেশ্য।” প্রাচীন গ্ৰীস রোম এবং আধুনিক প্রায় সকল সভ্যদেশেই ইতিহাসের প্রতি পক্ষপাত যেরূপ প্রকাশ পাইয়াছে ভারতবর্ষে কখনো তেমন ছিল না, ইহাতে বোধ করি দুই মত হইবে না । মান্ধাতার সমকালে । আমাদের দেশে হয়তো সবই ছিল- তখন টেলিগ্রাফ, রেলগাড়ি, বেলুন, ম্যাকসিম বন্দুক, ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ, এবং গ্যানো-রচিত প্ৰকৃতিবিজ্ঞান ছিল এমন অনেকে আভাস দিয়া থাকেন- কিন্তু, তখন ইতিহাস ছিল না । থাকিলে এমন-সকল কথা অল্প শুনা যাইত । কিন্তু আধুনিক ভারতবর্ষে যে সময়ে রাজপুতদের জনবন্ধন দৃঢ় ছিল তখন তাহাদের মধ্যে, উপযুক্ত মাটিতে উপযুক্ত চাষের মতো, ইতিহাস আপনি উদভিন্ন হইয়া উঠিত। আধুনিক ভারতে যখন হইতে মারাঠারা শিবাজীর প্রতিভাবলে এক জনসম্প্রদােয়রূপে বঞ্জের মতো বঁধিয়া গিয়াছিল এবং সেই বজ যখন জীর্ণ মোগল সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুৎ-বেগে ভাঙিয়া পড়িতেছিল, তখন হইতে তাহাদের ইতিহাস রচনার স্বাভাবিক কারণ ঘটে । ” তাহাদের ‘বখর নামধারী ইতিহাসগুলি প্রাচীন মহারাষ্ট্র-সাহিত্যের প্রধান অঙ্গ। ]