পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Gebr. রবীন্দ্র-রচনাবলী শিখদের ধর্মগ্রন্থ এবং তাঁহাদের জনসম্প্রদায়গঠনের ইতিহাস একত্র সম্মিলিত । তাহদের ধর্মমতে একেশ্বরবাদের মহান ঐক্য স্বভাবতই জাতীয় ঐক্যের কারণ হইয়াছিল । তাহারা যেমন ধর্মে এক, তেমনি কর্মে এক, তেমনি বলে এক হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাদের ধর্মগ্রন্থ একই কালে পুরাণ এবং ইতিহাস । • আসল কথা এই যে, জীবের ধর্ম যেমন বর্তমানে জীবনরক্ষা এবং ভবিষ্যতে বংশানুক্রমে আপনাকে স্থায়ী করিবার চেষ্টা, তেমনি যখন বহুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন লোককে কোনো একটি বিশেষ মত বা ভাব বা ধারাবাহিক স্মৃতিপরম্পরা এক জীবন দিয়া এক জীব করিয়া তোলে তখন সে বহিঃশত্রুর আক্রমণে খাড়া হইয়া দাড়াইতে পারে এবং ভবিষ্যৎ-অভিমুখে আপনি ব্যক্তিত্ব, আপনি সম্প্রদায়গত ঐক্যকে প্রেরণ করিবার জন্য যত্নবান হইয়া উঠে । ইতিহাস তাহার অন্যতম উপায় । এইজন্য কীটসমাজের পক্ষে বংশানুক্রমে প্রবালশৈলরচনার ন্যায় বিশেষ ঐক্যবদ্ধ জনসম্প্রদায়ের পক্ষে ইতিহাসরচনা প্রকৃতিগত ধর্ম। শাস্ত্র পুরাণ জনসমাজের সম্পূর্ণ ইতিহাস না হইলেও তােহা ধৰ্মসমাজের ইতিহাস। ধর্মমণ্ডলী আপন ধর্মের মহত্ত্ব সৌন্দর্য প্রাচীনতা সাধুদৃষ্টান্তমালা পুরাণে শাস্ত্রে গ্রথিত করিয়া ধর্মমতপ্রবাহকে অখণ্ড আকারে কাল হইতে কালান্তরে সঞ্চারিত করিয়া রাখে এবং সেই পুরাতন ঐক্যসূত্রে আপনি সম্প্রদায়কে দূরকালবদ্ধ বৃহৎ এবং সুদৃঢ় করিয়া তোলে। এইজন্য ঘটনার তথ্যতা রক্ষা করা পুরাণের উদ্দেশ্য নহে। তাহা কেবল ধর্মমত-ধর্মবিশ্বাসের ইতিবৃত্ত। তাহার কাল্পনিক অমূলক উক্তিসকলও বর্ণিত ধর্মনীতির আদর্শকেই ব্যক্ত করে। সাময়িক ঘটনাবলীর প্রকৃত বিবরণ তাহার লক্ষ্যের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু লোকেরা যখন কেবল ধর্মসম্প্রদায় বলিয়া নহে, জনসম্প্রদায় বলিয়া আপনার ঐক্য অনুভব করে, কেবল ধর্মরক্ষা নহে জনগত আত্মরক্ষা তাহদের পক্ষে স্বাভাবিক হইয়া উঠে, তখন তাহারা কেবল বিশেষ মত বা বিশ্বাস নহে পরস্তু আপনাদের ক্রিয়াকলাপর্বকীর্তি সুখদুঃখ ও সাময়িক ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করিতে থাকে । যখন আর্যগণ প্ৰথম ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন, যখন উদাসীন স্বাতন্ত্র্য র্তাহাদের আদর্শ ছিল না, যখন প্রাকৃতিক বাধা ও আদিম অনার্যের সহিত সংগ্রামে তাহাদিগকে সচেষ্ট দলবদ্ধ হইতে হইয়াছিল, যখন বীরপুরুষগণের স্মৃতি র্তাহাদিগকে বীর্যে উৎসাহিত করিত, তখন তাহাদের লিপিহীন সাহিত্যে ইতিহাসগাথার প্রাদুর্ভাব ছিল সন্দেহ নাই। সেই-সকল অতিপুরাতন খণ্ড-ইতিহাস বহুযুগ পরে মহাভারতে ও রামায়ণে নানা বিকারসহকারে একত্র সংযোজিত হইয়াছিল । কিন্তু প্ৰতিপদক্ষেপে যখন আর বন ছিল না এবং বনে যখন আর রাক্ষস ছিল না, যক্ষরক্ষীকিন্নরগণ যখন দুৰ্গম পর্বতে নির্বাসিত হইয়া জনপ্রবাদে ক্রমশ অলৌকিক আকার ধারণ করিল, অর্জনবিজয়ী কিরাতেশ্বর ধূর্জটি যখন দেবপদে উত্তীর্ণ হইলেন, প্রতিকূল প্রকৃতি এবং মানবের সংঘাত যখন দূর হইয়া গেল, যখন সুদীর্ঘ শান্তিকালে সূৰ্যকরোত্তপ্ত ভারতবর্ষে ব্ৰাহ্মণ সকলের প্রধান হইয়া আপন ঔদাস্যধর্মের বিপুলজাল হিমালয় হইতে কুমারিকা পর্যন্ত নিক্ষেপ করিল, তখন হইতে আর ইতিহাস রহিল না। ব্ৰাহ্মণের ধর্ম শত শত নব নব পুরাণে গ্রথিত হইতে লাগিল। কিন্তু জনসংঘ ক্ৰমে শিথিলীভুত হইয়া কোথায় ছড়াইয়া পড়িল, তাহাদের আর কোনো কথাই নাই। অতীত হইতেও তাহারা বিচ্যুত হইল, ভবিষ্যতের সহিতও তাহদের যোগ রহিল না । আসল কথা, ঐক্যের ধর্ম প্ৰাণধর্মের ন্যায় । সে জড়ধর্মের ন্যায় কেবল একাংশে বদ্ধ থাকে না । সে যদি এক দিকে প্রবেশ লাভ করে তবে ক্ৰমে আর-এক দিকেও আপনার অধিকার বিস্তার করিতে থাকে। সে যদি দেশে ব্যাপ্ত হইতে পায় তবে কালেও ব্যাপ্ত হইতে চায়। সে যদি নিকট এবং দূরের মধ্যে বিচ্ছেদ পূরণ করিতে পারে তবে অতীত এবং ভবিষ্যতের সঙ্গেও আপনি বিচ্ছিন্নতা দূর করিতে 05 की । এই অখণ্ডতার চেষ্টা এত প্রবল যে, অনেক সময়ে তাহা কল্পনার দ্বারা ইতিহাসের অভাব পূরণ