পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VeOO রবীন্দ্র-রচনাবলী যে-সকল নিভীক নাবিক ইহাতে সমবেত হইয়াছেন ঈশ্বর তঁহাদের আশীর্বাদ করুন, দেশের লোক তঁহাদের সহায় হউন এবং বাধাবিষ্ম ও নিরুৎসাহের মধ্যেও অনুরাগপ্রবৃত্ত মহৎ কর্তব্যসাধনের নিষ্কাম আনন্দ তাহাদিগকে ক্ষণকালের জন্য পরিত্যাগ না করুক । এ কথা কেহ না মনে করেন, গৌরব অনুসন্ধানের জন্য পুরাবৃত্তের দুৰ্গম পথে প্রবেশ করিতে হইবে । সে দিকে গৌরব না থাকিতেও পারে- অনেক পরাভব, অনেক অবমাননা, অনেক পতন ও বিকারের মধ্য দিয়া বাকিয়া বাকিয়া ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাস বহিয়া আসিয়াছে। অনেক স্থলে সেই একহাঁটু পঙ্কের ভিতর দিয়া আমাদিগকে হাঁটিতে হইবে। তবু আমাদিগকে এই পঙ্কিল জটিল বক্র পথের দিকে আকর্ষণ করিতেছে কে ? জাতীয় আত্মশ্লাঘা নহে, স্বদেশের প্রতি নবজাগ্ৰত প্ৰেম । আমরা দেশকে প্রকৃতরূপে প্রত্যক্ষরূপে সম্পূর্ণরূপে জানিতে চাই- তাহার সমস্ত দুঃখদুর্দশগতির মধ্যেও তাঁহাকে লক্ষ্য করিতে চাই- আপনাকে ভুলাইতে চাই না । তথাপি আমার দৃঢ়বিশ্বাস, ইতিহাসের পথ বাহিয়া ভারতবর্ষকে যদি আমরা সমগ্রভাবে দেখিতে পাই, আমাদের লজ্জা পাইবার কারণ ঘটিবে না । তাহা হইলে আমরা এমন একটি নিত্য আদর্শ লাভ করিব যাহা ভারতবর্ষের আদর্শ, যাহা সকল পরাভব ও অবমাননার উন্ধের্ব আপন উচ্চশির অম্লান রাখিতে পারিয়াছে । গ্ৰীক ও রোমকেরা বীর জাতি ছিল, বিজয়ী জাতি ছিল, তাহারা বহুকাল নিৰ্ভয়ে প্ৰাণের মমতা ত্যাগ করিয়া দেশজয় ও দেশরক্ষা করিয়া আসিয়াছিল । রাজনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষা তাহাদের জাতীয় লক্ষ্য ও গৌরব ছিল। কিন্তু সেই দৃঢ় আদর্শ, সেই বহুকালের সফলতা ও মহাদৃষ্টান্ত তাহাদিগকে পতনের ও । পরাভাবের হস্ত হইতে রক্ষা করিতে পারে নাই । ভারতবর্ষ নিজেকে যে পথে লইয়া গিয়াছিল। তাহা কোনো কালেই দেশরক্ষা ও দেশজয়ের পথ নহে । অতএব বহিঃশত্রুর বাহুবলের নিকট ভারতবর্ষের যে পরাভব সে তাহার আত্ম-আদর্শের পরাভব নহে । অবশ্য বাহিরের উপপ্লবে, শক গ্ৰীক আরব মোগল ও , ভারতবর্ষীয় অনার্যদের সংঘাতে ভারতবর্ষের তপোভঙ্গ হইয়াছিল ; যে আদর্শের ঐক্য ক্রমশ অভিব্যক্ত হইয়া, বিক্ষিপ্তত হইতে ক্রমশ সংক্ষিপ্ত ও দৃঢ় হইয়া হিন্দুজাতিকে একটি বিশেষ ভাবে ও গঠনে, শোভায় ও সামঞ্জস্যে সৃজন করিয়া তুলিতে পারিত, তাহা বারংবার ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিকীর্ণ হইয়া গিয়াছে, তথাপি নানা বিচ্ছেদের মধ্য দিয়াও সেই মূলসূত্রটি অনুসরণ করিতে পারিলে হয়তো বুঝিতে পারিব বর্তমান যুরোপের আদর্শ-দ্বারা ভারতবর্ষের ইতিহাস পরিমেয় নহে । ] যুরোপের আদর্শ য়ুরোপকে কোথায় লইয়া যাইতেছে তাহা আমরা কিছুই জানি না ; তাহা যে স্থায়ী নহে, তাহার মধ্যে যে অনেক বিনাশের বীজ অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছে তাহা স্পষ্ট দেখা যায়। ভারতবর্ষ প্রবৃত্তিকে দমন করিয়া শক্রহস্তে প্ৰাণত্যাগ করিয়াছে’- য়ুরোপ প্রবৃত্তিকে লালন করিয়া আত্মহত্যার উদযোগ করিতেছে। নিজদেশ এবং পরদেশের প্রতি আমাদের আসক্তি ছিল না বলিয়া বিদেশীর নিকট আমরা দেশকে বিসর্জন দিয়াছি- নিজদেশ ও পরদেশের প্রতি আসক্তি সযত্নে পোষণ করিয়া যুরোপ আজ কোন রক্তসমুদ্রের তীরে আসিয়া দাড়াইয়াছে! অন্ত্রে শস্ত্রে সর্বাঙ্গ কণ্টকিত করিয়া তুলিয়া তাহার এ কী বিকটমূর্তি ! কী সন্দেহ ও কী আতঙ্কের সহিত য়ুরোপের প্রত্যেক রাজশক্তি পরস্পরের প্রতি ক্রুর কটাক্ষপাত করিতেছে! রাজমন্ত্রিগণ টিপিয়া টিপিয়া পরস্পরের মৃত্যুচাল চালিতেছে ; রণতরীসকল মৃত্যুবাণে পরিপূর্ণ হইয়া পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রে যমদীেত্যে বাহির হইয়াছে। আফ্রিকায় এশিয়ায় যুরোপের ক্ষুধিত লুব্ধগণ আসিয়া ধীরে ধীরে এক-এক পা বাড়াইয়া একটা থাবায় মাটি আক্রমণ করিতেছে এবং আর-একটা থাবা সম্মুখের লোলুপ অভ্যাগতের প্রতি উদ্যত করিতেছে। য়ুরোপীয় সভ্যতার হিংসা ও লোভে অদ্য পৃথিবীর চারি মহাদেশ ও দুই মহাসমুদ্র ক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে। ইহার উপর আবার মহাজনদের সহিত মজুরদের, বিলাসের সহিত দুর্ভিক্ষের, দৃঢ়বন্ধ সমাজনীতির সহিত সোশ্যালিজম ও নাইহিলিজমের দ্বন্দ্ব যুরোপের সর্বত্রই আসন্ন হইয়া রহিয়াছে। প্রবৃত্তির প্রবলতা, প্রভুত্বের মত্ততা, স্বার্থের উত্তেজনা কোনাে কালেই শান্তি ও পরিপূর্ণতায়