পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO SR 囊 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পূজাকে তর্কের দ্বারা ধ্বংস করিতে ইচ্ছা করেন। কী হইতে পারে এবং কী হইতে পারে না, তর্ক অপেক্ষা ইতিহাসে তাহার প্রমাণ সহজে পাওয়া যায়। জল যে শীতে জমিয়া বরফ হইতে পারে উষ্ণপ্রধান দেশের রাজাকে তাহা তর্কে বুঝানো অসাধ্য ; কিন্তু যদি তিনি একবার নড়িয়া হিমালয়প্রদেশে ভ্ৰমণ করিয়া আসেন। তবে এ সম্বন্ধে আর কথা থাকে না । লেখক মহাশয় সে রাস্তায় যান নাই । তিনি তৰ্কদ্বারা বলিয়াছেন, নিরাকার উপাসনা . হইতেই পারে না । মুসলমানেরা মূর্তিপূজা করে না। অথচ মুসলমান-সম্প্রদায়ের মধ্যে ভক্ত কেহ নাই বা কখনাে জন্মোন নাই, এ কথা বিশ্বাস্য নহে। কী করিয়া যে তঁহাদের ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি হয় তাহা যতীন্দ্রমোহনবাবু না বুঝিতে পারেন। কিন্তু মূর্তিপূজা করিয়া নহে। এ কথা নিশ্চয় । নানক যে জগতের ভক্তশ্রেষ্ঠদের মধ্যে একজন নহেন তাহা কেহ সাহস করিয়া বলিবেন না । তিনি যে সোহহং ব্রহ্মবাদী ছিলেন না ইহাও নিঃসন্দেহ। তিনি যে প্রচলিত মূৰ্তি-উপাসনা বিশেষরূপে পরিত্যাগ করিয়া অমূর্ত উপাসনা প্রচার করিয়াছেন, ইহার একটি বৈ কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। নিশ্চয় তিনি নিরাকার উপাসনায় চরিতার্থতা লাভ করিতেন এবং মূৰ্তি-উপাসনায় তাহার ব্যাঘাত করিয়াছিল । R ব্ৰাহ্মদের মধ্যেও নিঃসন্দেহে কেহ-না-কেহ আছেন যিনি প্রবল ভক্তির আবেগবশতই মূর্তিপূজা পরিহারপূর্বক সমস্ত জীবন নিরাকার-উপাসনায় যাপন করিয়াছেন। গ্রন্থকারের মতে তিনি ভ্রান্ত হইতে পারেন, কিন্তু তিনি যে ভক্ত তাহা কেবল তর্কে নহে, আচরণে এবং বহু পীড়ন ও ত্যাগ স্বীকারে প্রমাণ করিয়াছেন । এককালে ভারতবর্ষে মূর্তিপূজা ছিল না, কিন্তু সেই দূরকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ উত্থাপন করা নিস্ফল । আধুনিক কালের যে কয়টি উদাহরণ দেওয়া গেল তাহা হইতে অন্তত এটুকু প্রমাণ হয় যে, কোনো কোনো ভক্ত মূর্তিপূজায় বিরক্ত হইয়া তাহা ত্যাগ করিয়াছেন এবং অনেক ভক্ত পৃথিবীর অনেক দেশে অমূর্ত উপাসনায় ভক্তিবৃত্তির পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছেন। গ্রন্থকার বলেন, মানিলাম তাহারা মূর্তিপূজা করেন না। কিন্তু তাহারা নিরাকার উপাসনা করেন ইহা হইতেই পারে না । কারণ, ‘জাতিবাচক ও গুণবাচক পদার্থের জ্ঞান সাকার’ এবং ‘জাতিবাচক ও গুণবাচক পদার্থ অবলম্বনে ঈশ্বরের জ্ঞান সাকার ।” এ কেমন তর্ক, যেমন- যদি আমি বলি ক বাকা পথে চলে এবং খ সোজা পথে চলে তুমি বলিতে পারো খ-ও সোজা পথে চলে না- কারণ সরল রেখা কাল্পনিক ; পৃথিবীতে কোথাও সরল রেখা নাই । কথাটা সত্য বটে। কিন্তু তথাপি ইহা তর্কমাত্র । আমাদের ভাষা আমাদের মনকে একদম ছাড়াইয়া যাইতে পারে না ; এবং আমাদের মন সীমাবদ্ধ। সুতরাং আমাদের ভাষা আপেক্ষিক। আমরা যাহাকে তীক্ষ বলি অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে তাহা ভেঁাতা হইয়া পড়ে, আমরা যাহাকে নিটােল গোল বলি তাহাকে সহস্ৰগুণ বাড়াইয়া দেখিলে তাহার অসমানতা ধরা পড়িয়া যায়। অণুবীক্ষণ দিয়া দেখিতে গেলে নিরাকার উপাসনার মধ্যে যে আকারের আভাস পাওয়া যায় না। তাহা বলিতে সাহস করি না । তাই যদি হইল, তবে আমরা যাহাকে সাকার উপাসনা বলি তাহাতেই বা দোষ কী ? নিরাকার যখন পূর্ণভাবে মনের অগম্য তখন র্তাহাকে সুগম আকারে পূজা করাই ভালো । আকার আমাদের মনের পক্ষে সুগম হইতে পারে, কিন্তু, তাই বলিয়া নিরাকার যে আকারের দ্বারা সুগম হইতে পারেন তাহা নহে- ঠিক তাহার উলটা । মনে করো, আমি সমুদ্রের ধারণা করিতে ইচ্ছা করি । সমুদ্র ক্রোশ-দুই তফাতে আছে। আমি তাহা দেখিতে যাত্রা করিবার সময় পণ্ডিত আসিয়া বলিলেন, সমুদ্র এতই বড়ো যে স্বচক্ষে দেখিয়াও তাহার ধারণা হইতে পারে না ; কারণ আমাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ ; আমরা সমুদ্রের মধ্যে যতই দূরে যাই, যতই প্ৰয়াস পাই, সমুদ্রকে ছোটো করিয়া দেখা ছাড়া উপায়ই নাই । অতএব তোমার অন্দরের মধ্যে একটি