পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য ●○○ কিন্তু দর্শনশক্তির সাধ্য সীমা দ্বারা সমুদ্র দেখিয়াও যদি সমুদ্রের ধারণা সম্পূর্ণ না হয় তবে ডোবা হইতে সমুদ্রের ধারণা অসম্ভব বলিলেও হয় । অনন্ত আকাশ আমাদের কাছে মণ্ডলবদ্ধ, কিন্তু তাই বলিয়া ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া আকাশ দেখার সাধ মিটাইতে পারি না । আমি যতদূর পর্যন্ত দেখিতে পাই তাহা না দেখিয়া আমার তৃপ্তি হয় না। এই যে প্ৰয়াস, বস্তুত ইহাই উপাসনা । আমার শেষ পর্যন্ত গিয়াও যখন তাহার শেষ পাই না, আমার মন যখন একাকী বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে যাত্ৰা করিয়া বাহির হয়, যখন অগণ্য গ্ৰহচন্দ্ৰতারকার অনন্ত জটিল জ্যোতিররণ্যমধ্যে সে হারাইয়া যায়, এবং প্রভাতকরািপ্লাবিত নীলাকাশের মহােচ্চদেশে বিলীনপ্রায় বিহঙ্গমের মতো উচ্ছসিত-কণ্ঠে গাহিয়া উঠে, তুমি ভুমা, আমি তোমার শেষ পাইলাম নাতখন তাহাতেই সে কৃতাৰ্থ হয়। সেই অন্ত না পাইয়াই তাহার সুখ, “ভূমৈব সুখং, নাল্পে সুখমস্তি ।” টলেমির জগৎতন্ত্র আমাদের ধারণাযোগ্য। পৃথিবীকে মধ্যে রাখিয়া বদ্ধ কঠিন আকাশে জ্যোতিষ্কগণ সংকীর্ণ নিয়মে ঘুরিতেছে ইহা ঠিক মনুষ্যমনের আয়ত্তগম্য ; কিন্তু অধুনা জ্যোতির্বিদ্যার বন্ধনমুক্তি হইয়াছে, সে সীমাবদ্ধ ধারণার বাহিরে অনন্ত রহস্যের মধ্যে গিয়া পড়িয়াছে বলিয়া তাহার গৌরব বাড়িয়াছে।। জগৎটা যে পৃথিবীর প্রাঙ্গণমাত্র নহে, পৃথিবী যে বিশ্বজগতে ধূলিকণার অধম এই সংবাদেই আমাদের কল্পনা প্রসারিত হইয়া যায় । আমাদের উপাস্য দেবতাকেও যখন কেবলমাত্র মনুষ্যের গৃহপ্ৰাঙ্গণের মধ্যে বদ্ধ করিয়া না দেখি, তাহাকে আমাদের ধারণার অতীত বলিয়া জানি, যখন ঋষিদের মুখে শুনি— যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্ৰাপ্য মনসা সহ আনন্দং ব্ৰহ্মণো বিদ্বানান বিভৌতি কুতশচন অর্থাৎ মনের সহিত বাক্য যাহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে সেই আনন্দকে সেই ব্ৰহ্মকে যিনি জানেন তিনি কাহা হইতেও ভয় পান না- তখনই আমাদের বদ্ধ হৃদয় মুক্তির আশ্বাস লাভ করিতে থাকে । বাক্য-মন র্যাহাকে না পাইয়া ফিরিয়া আসে তিনি যে আমাদের পক্ষে শূন্যস্বরূপ তাহা নহে, তিনিই जान्मन्छ । যাহাকে আমাদের অপেক্ষা বড়ো বলিয়া জানি তাহাকেই উপাসনা করি। আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনা তিনিই আকর্ষণ করেন যিনি এতবড়ো যে কোথাও তাহার শেষ নাই। তর্কের মুখে বলা যাইতে পারে, তাহাকে জানিব বড়ো করিয়া, কিন্তু দেখিব ছোটাে করিয়া । আপনাকে আপনি খণ্ডন করিয়া চলা কি সহজ কাজ ? বিশেষত ইন্দ্ৰিয় প্রশ্রয় পাইলে সে মনের অপেক্ষা বড়ো হইয়া উঠে। সেই ইন্দ্ৰিয়ের সাহায্য যতটুকু না লইলে নয় তদপেক্ষা বেশি কর্তৃত্ব তাহার হাতে স্বেচ্ছাপূর্বক সমর্পণ করিলে মনের জড়ত্ব অবশ্যম্ভাবী হইয়া পড়ে। তাহাকে ছোটো করিয়াই বা দেখিব কেন ? নতুবা তঁহাকে কিছু-একটা বলিয়া মনে হয় না, তিনি মন হইতে ক্রমশ স্বলিত হইয়া পড়েন । কিন্তু মহৎ লক্ষ্যের জন্য ফাকি দিয়া সারিবার সংক্ষিপ্ত রাস্তা নাই। দুর্গং পথ্যস্তৎ কবয়ো বদন্তি । সেই দুৰ্গম পথ এড়াইবার উপায় থাকিলে ভাবনা ছিল না। কষ্ট করিতে হয়, চেষ্টা করিতে হয় বলিয়া বিনা-প্ৰয়াসের পথ অবলম্বন করিলে লক্ষ্য ভ্ৰষ্ট হইয়া যায় । যে লোক ধনী হইতে চায় সে সমস্তদিন খাটিয়া রাত্রি একটা পর্যন্ত হিসাব মিলাইয়া। তবে শুইতে যায় ; পায়ের উপর পা দিয়া তাহার অভীষ্টসিদ্ধি হয় না। আর যে ঈশ্বরকে চায়, পথ দুৰ্গম বলিয়া সে কি খেলা করিয়া তাহাকে পাইবে ? আসল কথা, ঈশ্বরকে সকলে চায় না, পারমার্থিক দিকে স্বভাবতই অনেকের মন নাই। ধন্য ঐশ্বৰ্য সুখ সৌভাগ্য পাপক্ষয় এবং পুণ্য-অর্জনের দিকে লক্ষ রাখিয়া দেবসেবা ও ধর্মকর্ম করাকে জর্জ এলিয়ট other-worldliness নাম দিয়াছেন। অর্থাৎ সেটা পারলৌকিক বৈষয়িকতা । তাহা আধ্যাত্মিকতা নহে। যহাদের সেই দিকে লক্ষ সাকার-নিরাকার তাহাদের পক্ষে উপলক্ষমাত্র সুতরাং হাতের কাছে যেটা থাকে, যাহাতে সুবিধা পায়, দশ জনে যেটা পরামর্শ দেয় তাহাঁই অবলম্বন করিয়া ধর্মচাতুর লোক পুণ্যের খাতায় লাভের অঙ্ক জমা করিতে থাকেন। নিরাকারবাদী এবং সাকারবাদী V