পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য V OG হয় । আমাদের লোভ আমাদের হিংসা আমাদের ক্ষুদ্রতাকে দেবতারূপে অমর করিয়া রাখি । এই কারণেই কালীকে দস্য আপন দস্যবৃত্তির সহায় বলিয়া জ্ঞান করে, মিথ্যাশপথকারী আদালতে জয়লাভের জন্য পশু মানত করে, এমন-কি, যে-সকল অন্যায়-অবিচার-দুষ্কর্ম মনুষ্যলোকে গৰ্হিত বলিয়া খ্যাত, দেবচরিত্রে তাহাও অনিন্দনীয় বলিয়া স্থান পায় । আমাদের দেশের দেবতা কি কেবল মূর্তিতেই বদ্ধ যে রূপক ভাঙিয়া তাহার মধ্যে আমরা ভাবের স্বাধীনতা লাভ করিব ? চার হাতকে যেন আমরা চারিদিকবতী কর্মশীলতা বলিয়া মনে করিলাম। কিন্তু পুরাণে উপপুরাণে যাত্রায় কথকতায় তাহার জন্মমৃত্যুবিবাহ-রািগদ্বেষ-সুখদুঃখ-দৈন্যদুর্বলতার বিচিত্র পাঠ ও পাঠান্তর হইতে মনকে মুক্ত করিব কেমন করিয়া ? যতপ্রকার কৌশলে মানুষের মনকে ভুলইয়া একেবারে আটঘাটে বাধা যায় তাহার কোনােটারই ত্রুটি নাই। এবং এতপ্রকার সুদৃঢ় স্থূল শৃঙ্খলে চতুর্দিক হইতে সযত্ন বন্ধনকে গ্ৰন্থকার যদি তাহার নির্গুণ ব্ৰহ্মলাভের সোপান বলিয়া গণ্য করেন তবে মাছির পক্ষে মাকড়সার জালে পড়াই আকাশে উড়িবার উপায় মনে করা অসংগত হইবে দেবচরিত্র সম্বন্ধে যে-সকল ভ্ৰষ্ট আদর্শের কল্পনা আমাদের দেশে শাখাপল্লবিত হইয়া চারি দিকে শিকড় বিস্তার করিয়াছে, তাহা কল্পনার বিকার ; গ্রন্থকার বোধ করি তাহা হিন্দুসমাজের অধোগতির ফল বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সম্ভবত তাহা সংশোধন করিয়া লইতে উপদেশ দেন । সংশোধনের উপায় কী ? তিনি এক স্থলে বলিয়াছেন “সকল শাস্ত্রের মূলে এক বেদ, এক শ্রুতি- এক শ্রুতির দ্বারা সকল শাস্ত্রের বিরোধ ভঞ্জন করিবার বিধি রহিয়াছে।’ বিধি রহিয়াছে কিন্তু কেহ কখনাে চেষ্টা করিয়াছেন ? পৌরাণিক ধর্মের সহিত বৈদিক ধর্মের সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া কোনো পণ্ডিত আজ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের একটা অখণ্ড আদর্শ প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন কি ? ইহা কি সকলের দ্বারা সাধ্য ? পৌরাণিক ধর্ম ঐতিহাসিক হিন্দুধর্ম। কালক্রমে হিন্দুর অনেক পরিবর্তন হইয়াছে। বৈদিক আর্যগণ যে সমাজ, যে রীতি, যে বিশ্বাস, যে মানসিক প্রকৃতি লইয়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করিয়াছিলেন অনার্যদের সংঘর্ষে মিশ্রণে বিচিত্র অবস্থান্তরে স্বভাবের নিয়মে ক্রমশই তাহা রূপান্তরিত হইয়া আসিয়াছে। সেই সকল নব নব অভিব্যক্তি নব নব পুরাণে আপনাকে আকারবদ্ধ করিয়াছে। বেদ যে অবস্থার শাস্ত্ৰ, পুরাণ সে অবস্থার শাস্ত্ৰ নহে। সুতরাং বেদকেই যদি প্রমাণ বলিয়া মানা যায়। তবে পুরাণকে ছাড়িতে হয় এবং পুরাণকে প্রবল বলিয়া মানিলে বেদকে পরিহার করিতে হয়। এমন-কি, গ্ৰন্থকার নিজে বলিয়াছেন এবং ফলেও দেখা যায়, এক পুরাণকে মানিলে অন্য পুরাণের সহিত বিরোধ বাধিয়া উঠে । বর্তমানে হিন্দুসমাজ বেদকে মুখে মান্য করিয়া কাজের বেলা পুরাণকে অবলম্বন করে । উভয়ের মধ্যে যে কোনোপ্রকার অসামঞ্জস্য আছে সে তর্ক উত্থাপিত হয় না । হিন্দুধর্মের এই ঐতিহাসিক অভিব্যক্তি আজ পর্যন্ত চলিয়া আসিতেছে। কারণ, পুরাণ কেবল সংস্কৃত ভাষায় বদ্ধ নহে, প্রচলিত ভাষাতেও রচিত হয়। মনসার ভাসান, সত্যপীরের কথা প্রভৃতি তাহার দৃষ্টান্ত । মেয়েদের ব্ৰতকথাও তাহার উদাহরণ। অন্নদামঙ্গলে যদিও পৌরাণিক শিবদুর্গার লীলা বর্ণিত, এবং যদিও তাহার রচয়িতা ভারতচন্দ্ৰ শাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিত, তথাপি তাহার মধ্যে জনসাধারণ-প্ৰচলিত আধুনিক কল্পনাবিকার সহজেই স্থানলাভ করিয়াছে। কবিকঙ্কণচণ্ডীতেও তাঁহাই। হরপার্বতীর কেন্দল, কোচ-নারীদের প্রতি শিবের আসক্তি, নিজের গাত্ৰমল দিয়া দুৰ্গাকর্তৃক খেলার পুত্তলি নির্মাণ ও তাহা হইতে গণেশের জন্ম। এ-সমস্ত কাহিনী আধুনিক প্রাদেশিক ; শ্রুতি ইহার মূল নহে, লোকের কল্পনাই ইহার মূল, দেবতাকে নিজ পরিমাপে নির্মাণচেষ্টাই ইহার প্রধান কারণ। ইহার মধ্যে উচ্চ অঙ্গের আধ্যাত্মিক রূপক বাহির করা সাধারণ লোকের পক্ষে অসাধ্য এবং অসাধারণ লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য। সংক্ষেপে আমাদের শেষ বক্তব্য এই যে, যে-সকল ভক্ত মহাপুরুষ চিরপ্রথাগত সাকার উপাসনা