পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক जाश्णि o “তোমরা কথার ধ্বনির দ্বারা যে ফল পাইতে চাও আমি কথার অর্থ-স্বারা সেই ফল ইচ্ছা করি ; তোমরা কথার প্রাচুর্যের দ্বারা যাহা চাও আমি কথার নির্বাচনের দ্বারা তাহা চাই, তোমরা কথার সংগতির দ্বারা যাহা চাও আমি কথার পৃথকীকরণের দ্বারা তাহা লাভ করিতে প্রয়াসী। অথচ সংগতিও (harmony) ইচ্ছা করি কিন্তু তাহা স্বভাবসিদ্ধ যথাযোগ্য সংগতি ; জোড়া-গাথার নৈপুণ্যমাত্রের দ্বারা যে সংগতি রচিত তাহা চাই না ’ । বস্তুত প্রতিভাসম্পন্ন লেখক ও লিপিকুশল লেখকের প্রভেদ এই যে, একজনের রচনায় সংগতি এমন স্বাভাবিক এবং অখণ্ড যে, তাহা বিশ্লেষণ করাই শক্ত, অপরের রচনায় সংগতি ইটের উপর ইটের ন্যায় গাথা ও সাজানো। প্রথমটি অজ্ঞাতসারে মুগ্ধ করে, দ্বিতীয়টি বিন্যাসনৈপুণ্যে বাহবা বলায় । তর্কযুদ্ধ সম্বন্ধে জুবেয়ার বলেন“তর্কবিতর্কের প্রয়োজনীয়তা যতটুকু তাহার ঝঞ্জাট তদপেক্ষা অনেক বেশি। বিরোধমাত্রেই চিত্তকে বধির করিয়া ফেলে। যেখানে অন্য-সকলে বধির আমি সেখানে মুক।” জুবেয়ার বলেন‘কোনো কোনো চিত্ত নিজের জমিতে ফসল জন্মাইতে পারে না। কিন্তু জমির উপরিভাগে যে সার ঢালা থাকে। সেইখান হইতেই তাহার শস্য উঠে।” আমাদের কথা মনে পড়ে । আজকাল আমাদের দ্বারা যাহা উৎপন্ন হইতেছে সে কি যথার্থ আমাদের মনের ভিতর হইতে— না, ইংরাজি য়ুনিবার্সিটি গাড়ি বোঝাই করিয়া আমাদের প্রকৃতির উপরিভাগে যে সার বিছাইয়া দিয়াছে সেইখান হইতে ? এ সম্বন্ধে তর্ক তুলিলে বিরোধের সৃষ্টি হইতে পারে, অতএব মুক থাকাই ভালো । সমালোচনা সম্বন্ধে জুবেয়ারের কতকগুলি মত নিম্নে অনুবাদ করিয়া দিতেছি। পূর্বে যাহা সুখ দেয় নাই তাহাকে সুখকর করিয়া তোলা একপ্রকার নূতন সৃজন।” এই সৃজনশক্তি সমালোচকের । , *লেখকের মনের সহিত পরিচয় করাইয়া দেওয়াই সমালোচনার সৌন্দৰ্য । লেখায় বিশুদ্ধ নিয়ম মািছ কিনা তাহারই খবরদারি করা তাহার ব্যবসাগত কাজ বট কিন্তু সেইটিই সব চেয়ে কম “অকরুণ সমালোচনায় রুচিকে পীড়িত করে এবং সকল দ্রব্যের স্বাদে বিষ মিশাইয়া দেয় ।” “যেখানে সৌজন্য এবং শান্তি নাই সেখানে প্রকৃত সাহিত্যই নাই। সমালোচনার মধ্যেও দাক্ষিণ্য থাকা উচিত- না থাকিলে তাহা যথার্থ সাহিত্যশ্রেণীতে গণ্য হইতে পারে না ।” ‘ব্যাবসাদার সমালোচকরা আকাটা হীরা বা খনি হইতে তোলা সোনার ঠিক দর যাচাই করিতে পারে না। ট্যাকশালের চলতি টাকা পয়সা লইয়াই তাহদের কারবার। তাহাদের সমালোচনায় দাঁড়িপাল্লা আছে কিন্তু নিকষপথের অথবা সোনা গলাইয়া দেখিবার মুচি নাই।” “সাহিত্যের বিচারশক্তি অতি দীর্ঘকালে জন্মে এবং তাহার সম্পূর্ণ বিকাশ অত্যন্ত বিলম্বে ঘটে ।” ‘রুচি লইয়া সমালোচকদের উন্মত্ত উৎসাহ, তাহদের আক্রোশ-উত্তেজনা-উত্তাপ হাস্যকর । কাব্যসম্বন্ধে তাহারা এমনভাবে লেখে, কেবল ধর্মনীতি সম্বন্ধেই যাহা শোভা পায় । সাহিত্য মনোরাজ্যের জিনিস, তাহার সহিত মনোরাজ্যের আচার অনুসারেই চলা উচিত ; রোয্যের উদ্দীপনা, পিত্তের দাহ সেখানে অসংগত ।” রচনাবিদ্যার সম্বন্ধে জুবেয়ারের উপদেশগুলি নিজে লিখিত হইল । “অধিক ঝোক দিয়া বলিবার চেষ্টাতেই নবীন লেখকদের লেখা নষ্ট হয়, যেমন অধিক চড়া করিয়া গাহিতে গেলে গলা খারাপ হইয়া যায়। বেগ। কণ্ঠ ক্ষমতা এবং বুদ্ধির মিতপ্রয়োগ করিতে শেখাই রচনাবিদ্যা, এবং উৎকর্ষলাভের সেই একমাত্র রাস্তা ।” “সাহিত্যে মিতাচরণেই বড়ো লেখককে চেনা যায়। শৃঙ্খলা এবং অপ্ৰমত্ততা ব্যতীত প্ৰািজত হইতে পারে না এবং প্ৰজ্ঞতা ব্যতীত মহত্ব সম্ভবপর নহে।’ ]