পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve SQ O রবীন্দ্র-রচনাবলী কেন করি না তাহার কারণ, আমরা তর্ক করি, কিন্তু ঈশ্বরকে চাহি না । আমরা ব্ৰহ্মকে কখন চাই ? যখন দেখিতে পাই সংসারের, পরিমিত পদার্থমাত্রই পরিবর্তনশীলযখন এই চঞ্চল ঘূর্ণ্যমান বিষয়াবর্তের মধ্যে একটি নির্বিকার ধ্রুব অবলম্বনের জন্য আমাদের আত্মা ব্যাকুল হইয়া উঠে। তখন যিনি সকল আকার বিকার এবং সীমার অতীত সহজেই তাঁহাকেই চাই । যিনি- নিত্যোহনিত্যানাং, অনিতা সকলের মধ্যে নিত্য, চেতনশ্চেতনানাং, সমস্ত চেতনার চেতীয়ত, তাহাকে সেই নিত্যরূপে, সেই চেতায়িতারূপেই পাইতে চাই । তখন এ সংকল্প মনে উদয় হইতেই পাৱে না যে, নিরাকারকে আমরা কৌশলপূর্বক সাকাররূপে লাভ করিতে চেষ্টা করিব । যখন কারাগারের পাষাণভিত্তি আমাদিগকে ক্লিষ্ট করে তখন নূতন প্রাচীর গাথিয়া আমরা মুক্তি কল্পনা করিতে পারি না ; অসৎ যখন আমাদিগকে পীড়িত করে, যখন কাতর অন্তঃকরণ হইতে প্রার্থনা ধ্বনিত হইয়া উঠে, আসতো মা সদগময়, অসৎ হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, তখন কি নবতর অসত্যপােশ আমাদিগকে প্ৰলুব্ধ করিতে পারে ? আমরা ব্ৰহ্মকে কখন চাই ? একদিন যখন উপলব্ধি করি আমাদের প্রবৃত্তি আমাদের বাসনা মুহুর্তে মুহুর্তে অসৎ সংসারের ধূলিকদম আহরণ করিয়া আমাদের আলোকের পথ অবরুদ্ধ করিয়াছে ; আমরা সেই নিবিড় মোহান্ধকারে মণি বলিয়া যাহা সংগ্ৰহ করিতেছি তাহা মুষ্টির মধ্যে ধূলি হইয়া যাইতেছে, সুখ বলিয়া যাহা আলিঙ্গন করিতেছি তাহা সহস্রশিখা জ্বালারূপে আপাদমস্তক দগ্ধ করিতেছে, জল বলিয়া যাহা পান করিতেছি তাহা তৃষাত্তাশনে আহুতি-স্বরূপে বৰ্ষিত হইতেছে ; তখন পাপের বিভীষিকায় ভয়াতুর হইয়া যাহাকে ডাকিয়া বলি, “তমসো মা জ্যোতিৰ্গময় তিনি কি আমাদেরই মতো বাসনা-প্রবৃত্তির দ্বারা জড়িত সুখদুঃখপীড়িত পুরাণকল্পিত তমসাচ্ছন্ন দেবতা ? আমরা ব্ৰহ্মকে কখন চাই ? যখন আমাদের আত্মা ব্ৰহ্মবাদিনী মৈত্রেয়ীর ন্যায় সমস্ত সংসারকে এক পার্থে সরাইয়া দিয়া বলিয়া উঠে, যেন হং নামৃত স্যাম কিমহং তেন। কুর্যম, যাহার দ্বারা আমি অমর না হইব তাহা লইয়া আমি কী করিব ? আমরা সংসারের যত সুখ যত ঐশ্বর্য তাহার নিকট আহরণ করি! সে বলিতে থাকে, এ তো আমার মৃত্যুর উপকরণ ! সে আপনি ক্ষুধার অন্ন পিপাসার জল চাহিয়া উচ্চকণ্ঠে ডাকিয়া উঠে, মৃত্যোর্মামৃতং গময়, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও । মৃত্যুপীড়িত আত্মার সেই অমৃতস্বরূপ কে ?-- সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম আনন্দরূপমমৃতং যদবিভতি । সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ ব্ৰহ্ম, যিনি আনন্দরূপে অমৃতরূপে প্রকাশ পাইতেছেন। অতএব, যখন আমরা যথার্থীরাপে তাহাকে চাই তখন ব্ৰহ্ম বলিয়াই তাহাকে চাই । তিনি যদি সত্যস্বরূপ জ্ঞানস্বরূপ অনন্তস্বরূপ না হইতেন তবে এই অসৎ সংসার, এই অন্ধকার হৃদয়, এই মৃত্যুবীজসংকুল সুখসম্পদের মধ্যে থাকিয়া তাহাকে চাহিতাম না। কেন তবে আমরা তর্ক করিয়া থাকি যে, আমরা অপূর্ণ জীব এবং তিনি সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম, অতএব তীহাকে আমরা পাইতেই পারি না। এবং সেইজন্য অসত্য অজ্ঞান এবং অন্ধবিশিষ্ট আকারকে আমরা কেন তাহার স্থানে আরোপ করি ? আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই পূর্ণস্বরূপকে আমাদের একান্তই চাই, আমরা অপূর্ণ বলিয়াই সেই সত্যু জ্ঞানমনন্তঃ ব্ৰহ্মই আমাদের একমাত্র আনন্দ- একমাত্র মুক্তি। আমরা অপূর্ণ বলিয়াই আমরা অপূর্ণের পূজা করিব না ; অপূর্ণের উপরে আমাদের অমর আত্মার, আমাদের অনন্ত জীবনের প্রতিষ্ঠা স্থাপন করিব না ; আমরা এই অসৎ, এই অন্ধকার, এই মর্তবিষয়পুঞ্জের মধ্যস্থলে “শাস্তোদান্ত উপরিতস্তিতিক্ষুঃ সমাহিতোভূত্বা সাধনা করিতে থাকিব যতদিন না বলিতে পারি।-- বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ । भाष S७०४