পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা ܬܓ9ܛ তদুপযুক্ত পাকরস নিজের মধ্য হইতে জোগাইতে পারিতেছে না। লইতেছি মাত্র, কিন্তু পাইতেছি না। ইংরাজের সকল কার্যের ফলভোগ করিতেছি কিন্তু আমার করিতে পারিতেছি না এবং করিবার আশাও নিরস্ত হইতেছে । রাজ্য জয় করিয়া গৌরব এবং লাভ আছে, রাজ্য সুশাসন করিয়া ধর্ম এবং অর্থ আছে ; আর রাজাপ্রজার হৃদয়ের মিলন স্থাপন করিয়া কি কোনো মাহাত্ম্য এবং কোনো সুবিধা নাই। বর্তমান । কালের ভারত-রাজনীতির সেই কি সর্বাপেক্ষা চিন্তা এবং আলোচনার বিষয় নহে । কেমন করিয়া হইবে তাঁহাই প্রশ্ন । একে একে তো দেখানো গিয়াছে যে রাজাপ্রজার মধ্যে দুর্ভেদ্য দুরূহ স্বাভাবিক বাধাসকল বর্তমান । কোনো কোনো সহৃদয় ইংরাজিও সেজন্য অনেক সময় চিন্তা ও দুঃখ অনুভব করেন। তবু যাহা অসম্ভব, যাহা অসাধ্য, তাহা লইয়া বিলাপ করিয়া ফল কী । কিন্তু বৃহৎ কার্য, মহৎ অনুষ্ঠান কবে সহজ সুসাধ্য হইয়াছে। এই ভারতজয়-ভারতশাসনকার্যে ইংরাজের যে-সকল গুণের আবশ্যক হইয়াছে সেগুলি কি সুলভ গুণ । সে সাহস, সে অদম্য অধ্যবসায়, সে ত্যাগাস্বীকার কি স্বল্প সাধনার ধন । আর, পঞ্চবিংশতি কোটি বিদেশীয় প্রজার হৃদয় জয় করিবার জন্য যে দুর্লভ সহৃদয়তাগুণের আবশ্যক তাহা কি সাধনার যোগ্য নহে। ইংরাজ কবিগণ গ্ৰীস ইটালি হাঙ্গেরি পোলান্ডের দুঃখে আশ্রমোচন করিয়াছেন । আমরা ততটা অশ্রুপাতের অধিকারী নহি, কিন্তু এ-পর্যন্ত মহাত্মা এড়য়িন আর্নলড় ব্যতীত আর কোনো ইংরাজ কবি কোনো প্ৰসঙ্গ উপলক্ষে ভারতবর্ষের প্রতি প্রীতি ব্যক্ত করেন নাই । বরঞ্চ শুনিয়াছি, নিঃসম্পর্ক ফ্রান্সের কোনো কোনো বড়ো কবি ভারতবর্ষীয় প্রসঙ্গ অবলম্বন করিয়া কাব্য রচনা করিয়াছেন । ইহাতে ইংরাজের যতটা অনাত্মীয়তা প্রকাশ পাইয়াছে এমন আর-কিছুতেই নহে। ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষীয়দের লইয়া আজকাল ইংরাজি নভেল অনেকগুলি বাহির হইতেছে । শুনিতে পাই, আধুনিক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখক-সম্প্রদায়ের মধ্যে রাড়ইয়ার্ড কিপলিং প্রতিভায় অগ্রগণ্য । তাহার ভারতবষীয় গল্প লইয়া ইংরাজ পাঠকেরা অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়াছেন । উক্ত গল্পগুলি পড়িয়া তাহার একজন অনুরক্ত ভক্ত ইংরাজ কবির মনে কিরূপ ধারণা হইয়াছে তাহা পড়িয়াছি। সমালোচনা উপলক্ষে এড়মন্ড গস বলিতেছেন : এই-সকল গল্প পড়িতে পড়িতে ভারতবষীয় সেনানিবাসগুলিকে জনহীন বালুকাসমুদ্রের মধ্যবর্তী এক-একটি দ্বীপের মতো বোধ হয় । চারি দিকেই ভারতবর্ষের অপরিসীম মরুময়তাঅখ্যাত, একঘেয়ে, প্রকাণ্ড । সেখানে কেবল কালা আদমি, পারিয়া কুকুর, পাঠান, এবং সবুজবর্ণ টিয়াপাখি, চিল এবং কুম্ভীর, এবং লম্বা ঘাসের নির্জন ক্ষেত্র । এই মরুসমুদ্রের মধ্যবর্তী দ্বীপের কতকগুলি যুবাপুরুষ বিধবা মহারানীর কার্য করিতে এবং তঁহার অধীনস্থ পূর্বদেশীয় ধনসম্পদপূর্ণ বর্বর সাম্রাজ্য রক্ষা করিতে সুদূর ইংলন্ড হইতে প্রেরিত হইয়াছে। ইংরাজের তুলিতে ভারতবর্ষের এই শুষ্ক শোভাহীন চিত্র অঙ্কিত দেখিয়া মন নৈরাশ্যে বিষাদে পরিপূর্ণ হইয়া যায়। আমাদের ভারতবর্ষ তো এমন নয়। কিন্তু ইংরাজের ভারতবর্ষ কি এত তফাত । পরন্তু ভারতবর্ষের সহিত স্বার্থসম্পৰ্কীয় সম্বন্ধ লইয়া প্ৰবন্ধ আজকাল প্রায়ই দেখা যায় । ইংলন্ডের জনসংখ্যা প্রতিবৎসর বৃদ্ধি হইয়া ক্রমশ কী পরিমাণে খাদ্যাভাব হইতেছে এবং ভারতবর্ষ তাহা কী পরিমাণে পূরণ করিতেছে, এবং বিলাতি মালের আমদানি করিয়া বিলাতের বহুসংখ্যক শ্রমজীবীর হাতে কাজ দিয়া তাহদের কিরূপে জীবনোপায় করিয়া দিতেছে তাহার তালিকা বাহির হইতেছে । ইংলন্ড উত্তরোত্তর ভারতবর্ষকে তঁহাদেরই রাজগোষ্ঠের চিরপালিত গোরুটির মতো দেখিতেছেন। গোয়াল পরিষ্কার রাখিতে এবং খোল বিচালি জোগাইতে কোনো আলস্য নাই, এই অস্থাবর সম্পত্তিটি যাহাতে রক্ষা হয় সে পক্ষে তঁহাদের যত্ন আছে, যদি কখনো দৌরাত্ম্য করে সেজন্য শিংদুটা ঘষিয়া দিতে ঔদাসীন্য নাই, এবং দুই বেলা দুগ্ধ দোহন করিয়া লইবার সময় কৃশকায় বৎসগুলাকে একেবারে - বঞ্চিত করে না । কিন্তু তবু স্বার্থের সম্পর্কটাকেই উত্তরোত্তর জাজ্বল্যমান করিয়া তোলা হইতেছে। এই সকল প্ৰবন্ধে প্ৰায় একই সময় ভারতবর্ষের সহিত ইংরাজি উপনিবেশগুলিরও প্রসঙ্গ অবতারণা