পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set of UNC) করিয়াছিলেন । তিনি একাগ্রতার সহিত, নিষ্ঠার সহিত, হিন্দু মুসলমান খৃস্টান পারসি ধৰ্মজ্ঞাদিগের ধর্মালোচনা শ্রবণ করিতেন ও তিনি হিন্দু রমণীকে অন্তঃপুরে, হিন্দু অমাত্যদিগকে মন্ত্রিসভায়, হিন্দু বীরগণকে সেনানায়কতায় প্রধান আসন দিয়াছিলেন । তিনি কেবল রাজনীতির দ্বারায় নহে, প্রেমের দ্বারা সমস্ত ভারতবর্ষকে, রাজা ও প্রজাকে এক করিতে চাহিয়াছিলেন। সূর্যস্তভূমি হইতে বিদেশী । আসিয়া আমাদের ধর্মে কোনো হস্তক্ষেপ করে না- কিন্তু সেই নির্লিপ্ততা প্ৰেম না। রাজনীতি ? উভয়ের মধ্যে আকাশপাতিল প্ৰভেদ । কিন্তু একজন মহদাশয় ক্ষণজন্ম পুরুষ যে অত্যুচ্চ আদর্শ লাভ করিয়াছিলেন একটি সমগ্ৰ জাতির নিকট তাহা প্ৰত্যাশা করা যায় না । সেইজন্য কবির স্বপ্ন কবে সত্য হইবে বলা কঠিন । বলা আরো কঠিন এইজন্য যে, দেখিতে পাইতেছি, রাজাপ্রজার মধ্যে যে চলাচলের পথ ছিল, উভয় পক্ষে কাটােগাছের ঘের দিয়া প্ৰতিদিন সে পথ মারিয়া লইতেছেন । নব নব বিদ্বেষ মিলনক্ষেত্ৰকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিতেছে । রাজ্যের মধ্যে এই প্রেমের অভাব আমরা আজকাল এত অধিক করিয়া অনুভব করি যে, লোকের মনে ভিতরে ভিতরে একটা আশঙ্কা এবং অশান্তি আন্দোলিত হইতেছে। তাহার একটা দৃষ্টান্ত দেখা যায় যে, আজকাল হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ উত্তরোত্তর যে নিদারুণতর হইয়া উঠিতেছে, আমরা আপনাদের মধ্যে তাহা লইয়া কিরূপ বলা-কহা করি । আমরা কি গোপনে বলি না যে, এই উৎপাতের প্রধান কারণ- ইংরাজরা এই বিরোধ নিবারণের জন্য যথার্থ চেষ্টা করে না । তাহদের রাজনীতির মধ্যে প্রেমনীতির স্থান নাই। ভারতবর্ষের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহারা প্রেমের অপেক্ষা ঈর্ষা বেশি করিয়া বপন করিয়াছে। ইচ্ছাপূর্বক করিয়াছে এমন নাও হইতে পারে ; কিন্তু আকবর যে-একটি প্রেমের আদর্শে খণ্ড-ভারতবর্ষকে এক করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, ইংরাজের পলিসির মধ্যে সেই আদর্শট নাই বলিয়াই এই দুই জাতির স্বাভাবিক বিরোধ হ্রাস না হইয়া উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইবার উপক্রম দেখা যাইতেছে। কেবল আইনের দ্বারা, শাসনের দ্বারা এক করা যায় না ; অন্তরে প্রবেশ করিতে হয়, বেদনা বুঝিতে হয়, যথার্থ ভালোবাসিতে হয়- আপনি কাছে আসিয়া হাতে হাতে ধরিয়া মিলন করাইয়া দিতে হয় । কেবল পুলিস মোতাইন করিয়া এবং হাতকড়ি দিয়া শান্তিস্থাপন করায় দুর্ধর্ষ বলের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা ঠিক আকবরের স্বপ্নের মধ্যে ছিল না, এবং সূর্যস্তভূমির কবিগণ অলীক অহংকার না করিয়া যদি বিনীত প্রেমের সহিত, সুগভীর আক্ষেপের সহিত, স্বজাতিকে লাঞ্ছনা করিয়া প্রেমের সেই উচ্চ আদর্শ শিক্ষা দেন। তবে তঁহাদের স্বজাতিরও উন্নতি হয় এবং এই আশ্রিতবর্গেরও উপকার হয় । ইংরাজের আত্মাভিমান সভ্যতগর্ব জাত্যহংকার কি যথেষ্ট নাই । কবি কি কেবল সেই অগ্নিতেই আহুতি দিবেন। এখনো এখনো কি নম্রতা শিক্ষা ও প্ৰেমচৰ্চার সময় হয় সৌভাগের উন্নততম শিখরে অবরোহণ করিয়া এখনাে কি ইংরাজ কৰি কেবল আন্ধঘোষণা কিন্তু আমাদের মতো অবস্থাপন্ন লোকের মুখে এ-সকল কথা কেমন শোভন হয় না, সেইজন্য বলিতেও লজ্জা বোধ হয় । দায়ে পড়িয়া প্ৰেম ভিক্ষা করার মতো দীনতা আর কিছু নাই। এবং এ সম্বন্ধে দুই-এক কথা আমাদিগকে মাঝে মাঝে শুনিতেও হয় । মনে পড়িতেছে, কিছুদিন হইল ভক্তিভাজন প্ৰতাপচন্দ্র মজুমদার মহাশয়ের এক পত্রের উত্তরে লন্ডনের স্পেক্টেটর পত্র বলিয়াছিলেন, নব্য বাঙালিদের অনেকগুলা ভালো লক্ষণ আছে ; কিন্তু একটা দোষ দেখিতেছি, সিমপ্যাথি-লালসাটা তাহাদের বড়ো বেশি হইয়াছে। এ দোষ স্বীকার করিতে হয় এবং এতক্ষণ আমি যেভাবে কথাগুলা বলিয়া আসিতেছি তাহতে এ দোষ হাতে হাতে প্রমাণ হয়। ইংরাজের কােছ হইতে আদর পাইবার ইচ্ছাটা আমাদের কিছু অস্বাভাবিক পরিমাণে বাড়িয়া উঠিয়াছে। তাহার কারণ, আমরা স্পেক্টেটরের ন্যায় স্বাভাবিক অবস্থায় নাই। আমরা যখন তুষার্ত হইয়া চাহি এক ঘটি জল আমাদের রাজা তখন তাড়াতাড়ি এনে দেয়। আধখানা বোলাঁ । আধখানা বেল সময়বিশেষে অত্যন্ত উপাদেয় হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে ক্ষুধা-তৃষ্ণা দুই একসঙ্গে দূর