পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set ser VN26ł সংসারে উদযোগপর্বের পূর্বে অজ্ঞাতবাসের পর্ব। আমাদেরও এখন আত্মনির্মাণ-জাতিনির্মাণের অবস্থা, এখন আমাদের অজ্ঞাতবাসের সময় । কিন্তু এমনি আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা বড়োই বেশি প্রকাশিত হইয়া পড়িয়ছি। আমরা নিতান্ত অপরিপক্ক অবস্থাতেই অধীরভাবে ডিম্ব ভাঙিয়া বাহির হইয়া পড়িয়াছি, এখন প্রতিকুল সংসারের মধ্যে এই দুর্বল অপরিণত শরীরের পুষ্টিসাধন বড়ো কঠিন হইয়া পড়িয়াছে। আমরা আজ পৃথিবীর রণভূমিতে কী অস্ত্ৰ লইয়া আসিয়া দাড়াইলাম। কেবল বক্তৃতা এবং আবেদন ? কী বর্ম পরিয়া আত্মরক্ষা করিতে চাহিতেছি । কেবল ছদ্মবেশ ? এমন করিয়া কতদিনই-বা কাজ চলে এবং কতটুকুই বা ফল হয় । একবার নিজেদের মধ্যে অকপটচিত্তে সরলভাবে স্বীকার করিতে দোষ কী যে, এখনো আমাদের চরিত্রবল জন্মে নাই। আমরা দলাদলি ঈর্ষা ক্ষুদ্রতায় জীর্ণ। আমরা একত্র হইতে পারি না, পরস্পরকে বিশ্বাস করি না, আপনাদের মধ্যে কাহারও নেতৃত্ব স্বীকার করিতে চাহি না । আমাদের বৃহৎ অনুষ্ঠানগুলি বৃহৎ বুদবুদের মতো ফাটিয়া যায় ; আরম্ভে ব্যাপারটা খুব তেজের সহিত উদভিন্ন হইয়া উঠে, দুইদিন পরেই সেটা প্ৰথমে বিচ্ছিন্ন, পরে বিকৃত, পরে নিজীবী হইয়া যায়। যতক্ষণ-না যথার্থ ত্যাগাস্বীকারের সময় আসে ততক্ষণ আমরা ক্ৰীড়াসক্ত বালকের মতো একটা উদযোগ লইয়া উন্মত্ত হইয়া থাকি, তার পরে কিঞ্চিৎ ত্যাগের সময় উপস্থিত হইলেই আমরা নানান ছুতায় স্ব স্বগৃহে সরিয়া পড়ি। আত্মাভিমান কোনো কারণে তিলমাত্র ক্ষুন্ন হইলে উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব সম্বন্ধে আমাদের আর কোনো জ্ঞান থাকে না । যেমন করিয়া হউক, কাজ আরম্ভ হইতে না-হইতেই তপ্ত তপ্ত নামটা চাই । বিজ্ঞাপন রিপোর্ট ধুমধাম এবং খ্যাতিটা যথেষ্ট পরিমাণে হইলেই আমাদের এমনি পরিপূর্ণ পরিতৃপ্তি বোধ হয় যে, তাহার পরেই প্রকৃতিটা নিদ্রালিস হইয়া আসে ; ধৈৰ্যসাধ্য শ্রমসাধ্য নিষ্ঠাসাধ্য কাজে হাত দিতে আর তেমন গা লাগে না । এই দুর্বল অপরিণত শতজীৰ্ণ চরিত্রটা লইয়া আমরা কী সাহসে বাহিরে আসিয়া দাড়াইয়াছি তাহাই বিস্ময় এবং ভাবনার বিষয় । এরূপ অবস্থায় অসম্পূর্ণতা সংশোধন না করিয়া অসম্পূর্ণতা গোপন করিতেই ইচ্ছা যায়। একটা কোনাে আত্মদোষের সমালোচনা করিতে গেলেই সকলে মিলিয়া মুখ চাপিয়া ধরে ; বলে, আরো চুপ চুপ, ইংরাজেরা শুনিতে পাইবে- তাহারা কী মনে করিবে । আবার আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে ইংরািজও অনেকগুলি বিষয়ে কিছু স্থূলদৃষ্টি। ভারতবষীয়ের মধ্যে যে বিশেষ গুণগুলি আছে এবং যেগুলি বিশেষ সমাদরের যোগ্য তাহা তাহারা তলাইয়া গ্ৰহণ করিতে পারে না ; অবজ্ঞাভরেই হউক বা যে কারণেই হউক, তাহারা বিদেশী আবরণ ভেদ করিতে পারে না বা চাহে না। তাহার একটা দৃষ্টান্ত দেখাে- বিদেশে থাকিয়া জর্মান যেমন একাগ্রতার সহিত আমাদের সংস্কৃত শাস্ত্রের অনুশীলন করিয়াছে স্বক্ষেত্রে উপস্থিত থাকিয়া ইংরাজ তেমন করে নাই। ইংরাজ ভারতবর্ষে জীবনযাপন করে এবং দেশটাকে সম্পূর্ণই দখল করিয়াছে কিন্তু দেশী ভাষাটা দখল করিতে পারে न्माष्ट्र । অতএব ইংরাজ ভারতবষীয়কে ঠিক ভারতবর্ষীয়ভাবে বুঝিতে এবং শ্রদ্ধা করিতে অক্ষম। এজন্য আমরা অগত্যা ইংরাজকে ইংরাজি-ভাবেই মুগ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছি। মনে যাহা জানি মুখে তাহা বলি না, কাজে যাহা করি কাগজে তাহা বাড়াইয়া লিখি । জানি যে ইংরাজ পীপাল-নামক একটা পদার্থকে জুজুর মতো দেখে, আমরাও সেইজন্য কোনোমতে পাচজনকে জড়ো করিয়া পীপাল সাজিয়া গলা গভীর করিয়া ইংরাজকে ভয় দেখাই। পরস্পরকে বলি, কী করিব ভাই, এমন না করিলে উহারা যদি কোনো কথায় কৰ্ণপাত না করে তবে কী করা যায়। উহারা কেবল নিজের দন্তুরটাই বোঝে । এইরূপে ইংরাজের স্বভাবগুণেই আমাদিগকে ইংরাজের মতো ভান করিয়া, আড়ম্বর করিয়া, তাহাদের নিকট সম্মান এবং কাজ আদায় করিতে হয়। কিন্তু তবু আমি বলি, সর্বাপেক্ষা ভালো কথা এই যে আমরা সাজিতে পারিব না। না সাজিলে কর্তারা যদি আমাদিগকে একটুখানি অধিকার বা (18S