পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

We8 SR রবীন্দ্র-রচনাবলী তুলিতে সংকোচ বোধ করে, ছােটাে ছোটাে কর্তারা কোনো সুযোগে একবার আমাদিগকে হাতে পাইলে ছাড়িতে চায় না এবং ভারতবষীয় ইংরাজের বড়ো বড়ো খবরের কাগজগুলা শৃঙ্খলবদ্ধ কুকুরের মতো দাত বাহির করিয়া আমাদের প্রতি অবিশ্রাম তারস্বর প্রয়োগ করিতে থাকে। ভালো, যেন আমরাই চুপ করিলাম, কিন্তু তোমাদের আপনাদিগকে থামাও দেখি । তোমাদের মধ্যে র্যাহারা স্বার্থকে উপেক্ষা করিয়া ধর্মের পতাকা ধরিয়া দণ্ডায়মান হন। তঁহাদিগকে নির্বাসিত করো, তোমাদের জাতীয় প্রকৃতিতে যে ন্যায়পরতার আদর্শ আছে তাহাকে পরিহাস করিয়া স্নান করিয়া দাও । কিন্তু সে কিছুতেই হইবে না। তোমাদের রাজনীতির মধ্যে ধর্মবুদ্ধি একটা সত্য পদার্থ। কখনো-বা তাহার জয় হয়, কখনো-বা তাহার পরাজয় হয় ; কিন্তু তাহাকে বাদ দিয়া চলিতে পারে না। আয়ার্লন্ড যখন ব্রিটানিয়ার নিকট কোনাে অধিকার প্রার্থনা করে তখন সে যেমন এক দিকে খুনের ছুরিতে শান দিতে থাকে তেমনি অন্য দিকে ইংলন্ডের ধর্মবুদ্ধিকে আপনি দলে লইতে চেষ্টা করে। ভারতবর্ষ যখন বিদেশী স্বামীর দ্বারে আপনি দুঃখ নিবেদন করিতে সাহসী হয় তখন সেও ইংরাজের ধর্মবুদ্ধিকে আপন সহায় করিবার জন্য ব্যগ্র হয় । মাঝে হইতে ইংরাজের রাজকার্যে ল্যাঠা বিস্তর বাড়িয়া যায়। কিন্তু যতদিন ইংরাজপ্রকৃতির কোথাও এই সচেতন ধর্মবুদ্ধির প্রভাব থাকিবে, যতদিন তাহার নিজের মধ্যেই তাহার নিজের সুকৃতি-দুষ্কৃতির একটি বিচারক বর্তমান থাকিবে, ততদিন আমাদের সভাসমিতি বাড়িয়া চলিবে, আমাদের সংবাদপত্র ব্যাপ্ত হইতে থাকিবে । ইহাতে আমাদের বলবান ইংরাজগণ বিফল গাত্রদাহে। যতই অধীর হইয়া উঠিবে, আমাদের উৎসাহ এবং উদ্যমের আবশ্যকতা ততই আরো বাড়াইয়া তুলিবে মাত্র । Ꭹ ᏬOO অপমানের প্রতিকার একদা কোনো উচ্চপদস্থ বাঙালি গবর্মেন্ট -কর্মচারীর বাড়িতে কোনো কলেজের ইংরাজ অধ্যক্ষ নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। তখন জুরি-দমন বিল লইয়া দেশে একটা আন্দোলন উপস্থিত হইয়াছিল। আহারান্তে নিমন্ত্রিত মহিলাগণ পার্শ্ববতী গৃহে উঠিয়া গেলে প্রসঙ্গক্রমে জুরিপ্রথার কথা উঠিল। ইংরাজ প্রোফেসর কহিলেন, যে দেশের লোক অর্ধসভ্য, অর্ধশিক্ষিত, যাহাদের ধমনীতির আদর্শ উন্নত নহে, জুরির অধিকার তাহাদের হস্তে কুফল প্রসব করে। শুনিয়া এই কথা মনে করিলাম, ইংরাজ এত অধিক সভ্য হইয়াছে যে, আমাদের সহিত সভ্যতা রক্ষা সে বাহুল্য জ্ঞান করে । আমাদের নৈতিক আদর্শকত মাত্রা উঠিয়াছে অথবা নামিয়াছে জানি না, কিন্তু ইহা জানি, র্যাহার আতিথ্য ভোগ করিতেছি তাহার স্বজাতিকে পরুষবাক্যে অবমাননা করা আমাদের শিষ্টনীতির আদর্শের অনেক বাহিরে । অধ্যাপকমহাশয় আর-একটি কথা বলিয়াছিলেন, যে কথা কেবলমাত্র অমিষ্ট ও অশিষ্ট নহে, পরন্তু ইংরাজের মুখে অত্যন্ত অসংগত শুনিতে হইয়াছিল। তিনি বলিয়াছিলেন, জীবনের পবিত্রতা, অর্থাৎ জীবনের প্রতি হস্তক্ষেপ করার পরমদূষণীয়তা সম্বন্ধে ভারতবাসীর ধারণা ইংরাজের তুলনায় অত্যন্ত স্বল্পপরিমিত । সেইজন্য হত্যাকারীর প্রতি ভারতবষীয় জুরির মনে যথোচিত বিদ্বেষের উদ্রেক হয় না। যাহারা মাংসাশী জাতি এবং যাহারা বিরাট হত্যাকাণ্ডের দ্বারা পৃথিবীর দুই নবাবিষ্কৃত মহাদেশের মধ্যে আপনাদের বাসযোগ্য স্থান পরিষ্কার করিয়া লইয়াছে, এবং সম্প্রতি তরবারির দ্বারা তৃতীয় মহাদেশের প্রচ্ছন্ন বক্ষোদেশ অল্পে অল্পে বিদীর্ণ করিয়া তাহার শস্য-অংশটুকু সুখে ভক্ষণ করিবার উপক্ৰম করিতেছে, তাহারা যদি নিমন্ত্রণ-সভায় আরামে ও স্পর্ধাভরে নৈতিক আদর্শের উচ্চ দণ্ডে চড়িয়া বসিয়া জীবনের পবিত্রতা ও প্ৰাণহিংসার অকর্তব্যতা সম্বন্ধে অহিংসক ভারতবর্ষকে উপদেশ দিতে থাকে। তবে ‘অহিংসা পরমো ধৰ্মঃ এই শাস্ত্ৰবাক্য স্মরণ করিয়াই সহিষ্ণুতা অবলম্বন করিতে হয়।