পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዪኃ8br রবীন্দ্র-রচনাবলী পক্ষপাত প্ৰকাশ করিতেছেন এ অপবাদকেও তঁাহারা সম্পূর্ণ অমূলক বলিয়া তিরস্কার করিয়াছেন। আমরাও র্তাহাদের কথা অবিশ্বাস করি না । কনগ্রেসের প্রতি গবর্মেন্টের সুগভীর প্রীতি না থাকিতে পারে এবং মুসলমানগণ হিন্দুদের সহিত যোগ দিয়া কনগ্রেসকে বলশালী না করুক এমন ইচ্ছাও তঁহাদের থাকা সম্পূর্ণ সম্ভব, তথাপি রাজ্যের দুই প্রধান সম্প্রদায়ের অনৈক্যকে বিরোধে পরিণত করিয়া তোলা কোনো পরিণামদেশী বিবেচক গবমেন্টের অভিপ্রেত হইতে পারে না । অনৈক্য থাকে সে ভালো, কিন্তু তাহা গবর্মেন্টের সুশাসনে শান্তমূর্তি ধারণ করিয়া থাকিবে । গবর্মেন্টের বারুদখানায় বারুদ যেমন শীতল হইয়া আছে অথচ তাহার দাহিকাশক্তি নিবিয়া যায় নাই- হিন্দু-মুসলমানের আভ্যন্তরিক অসদ্ভাব্য গবর্মেন্টের রাজনৈতিক শস্ত্রশালায় সেইরূপ সুশীতলভাবে রক্ষিত হইবে, এমন অভিপ্ৰায়। গবর্মেন্টের মনে থাকা অসম্ভব নহে । এই কারণে গবর্মেন্ট হিন্দু-মুসলমানের গলাগলি-দৃশ্য দেখিবার জন্যও ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতেছেন না, অথচ লাঠালাঠি-দৃশ্যটাও তাঁহাদের সুশাসনের হানিজনক বলিয়া বিরক্ত হইয়া উঠিতেছেন। সর্বদাই দেখিতে পাই, দুই পক্ষে যখন বিরোধ ঘটে এবং শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা উপস্থিত হয় তখন ম্যাজিষ্ট্রেট সূক্ষ্মবিচারের দিকে না গিয়া উভয় পক্ষকেই সমানভাবে দমন করিয়া রাখিতে চেষ্টা করেন । কারণ, সাধারণ নিয়ম এই যে, এক হাতে তালি বাজে না । কিন্তু হিন্দু-মুসলমান-বিরোধে সাধারণের বিশ্বাস দৃঢ়বদ্ধমূল হইয়াছে যে, দমনটা অধিকাংশ হিন্দুর উপর দিয়াই চলিতেছে এবং প্রশ্রয়টা অধিকাংশ মুসলমানেরাই লাভ করিতেছেন । এরূপ বিশ্বাস জন্মিয়া যাওয়াতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঈর্ষানল আরো অধিক করিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছে ; এবং যেখানে কোনােকালে বিরোধ ঘটে নাই সেখানেও কর্তৃপক্ষ আগেভাগে অমূলক আশঙ্কার অবতারণা করিয়া এক পক্ষের চিরাগত অধিকার কাড়িয়া লওয়াতে অন্য পক্ষের সাহস ও স্পর্ধা বাড়িতেছে এবং চিরবিরোধের বীজ বপন করা হইতেছে । হিন্দুদের প্রতি গবমেন্টের বিশেষ-একটা বিরাগ না থাকাই সম্ভব, কিন্তু একমাত্র গবর্মেন্টের পলিসির দ্বারাই গবমেন্ট চলে না— প্রাকৃতিক নিয়ম একটা আছে। স্বৰ্গরাজ্যে পবনদেবের কোনোপ্রকার অসাধু অভিপ্ৰায় থাকিতে পারে না, তথাচ উত্তাপের নিয়মের বশবর্তী হইয়া তাহার মর্তরাজ্যের অনুচর উনপঞ্চাশ বায়ু অনেক সময় অকস্মাৎ ঝড় বাধাইয়া বসে। আমরা গবর্মেন্টের স্বৰ্গলোকের খবর ঠিক করিয়া বলিতে পারি না, সে-সকল খবর লর্ড ল্যান্সডাউন এবং লর্ড হ্যারিস জানেন ; কিন্তু আমরা আমাদের চতুর্দিকের হাওয়ার মধ্যে একটা গোলযোগ অনুভব করিতেছি। স্বৰ্গধাম হইতে মাভৈঃ মাভৈঃ শব্দ আসিতেছে, কিন্তু আমাদের নিকটবতী দেবাচরগণের মধ্যে ভারি একটা উষ্মার লক্ষণ প্ৰকাশ পাইতেছে। মুসলমানেরাও জানিতেছেন, তাহাদের জন্য বিষ্ণুদূত অপেক্ষা করিয়া আছে ; আমরাও হাড়ের মধ্যে কম্পসহকারে অনুভব করিতেছি, আমাদের জন্য যমদূত দ্বারের নিকট গদাহন্তে বসিয়া আছে এবং উপরন্তু সেই যমদূতগুলার খোরাকি আমাদের নিজের গাঠ হইতে দিতে হইবে। হাওয়ার গতিক আমরা যেরূপ অনুভব করিতেছি তাহা যে নিতান্ত অমূলক এ কথা বিশ্বাস হয় না। অল্পকাল হইল স্টেটসম্যান পত্রে গবর্মেন্টের উচ্চ-উপাধিধারী কোনো শ্ৰদ্ধেয় ইংরাজ সিভিলিয়ান প্রকাশ করিয়াছেন যে, আজকাল সাধারণ ভারতবষীয় ইংরাজের মনে একটা হিন্দুবিদ্বেষের ভােব ব্যাপ্ত হইয়াছে এবং মুসলমানজাতির প্রতিও একটি আকস্মিক বাৎসল্যরসের উদ্রেক দেখা যাইতেছে। মুসলমান-ভ্রাতাদের প্রতি ইংরাজের স্তনে যদি ক্ষীরসঞ্চার হইয়া থাকে। তবে তাহা আনন্দের বিষয়, কিন্তু মুকুতি যদি কেবলই পিত্তসঙ্কর হতে থাকে স্তরে সে আনন্দ অকপটভাবে রক্ষা করা কঠিন হইয়া কেবল র্যাগদ্বেষের দ্বারা পক্ষপাত এবং অবিচার ঘটিতে পারে তাহা নহে, ভয়েতে করিয়াও ন্যায়পরতার নিক্তির কাটা অনেকটা পরিমাণে কম্পিত বিচলিত হইয়া উঠে । আমাদের এমন সন্দেহ হয় যে, ইংরাজ মুসলমানকে মনে মনে কিছু ভয় করিয়া থাকেন। এইজন্য রাজদণ্ডটা মুসলমানের গা ঘেষিয়া ঠিক হিন্দুর মাথার উপরে কিছু জোরের সহিত পড়িতেছে। ।