পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Wg Gʻ2O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী নিয়মানুবতী হইয়া যথোপযুক্ত স্থানে গিয়া আঘাত করিয়াছিল। ক্যানাট মুখের কথায় বা মন্ত্রোচ্চারণে তাহাকে ফিরাইতে পারিতেন না বটে, কিন্তু বাধ বাধিয়া তাহাকে প্রতিহত করিতে পারিতেন । স্বাভাবিক নিয়মানুগত আঘাতপরম্পরাকে যদি অর্ধপথে বাধা দিতে হয় তবে আমাদিগকে বাধ বাধিতে হইবে। সকলকে এক হইতে হইবে, সকলকে সমাহৃদয় হইয়া সমবেদনা অনুভব করিতে হইবে । দল বাধিয়া যে বিপ্লব করিতে হইবে তাহা নহে- আমাদের সে শক্তিও নাই। কিন্তু দল বাধিলে যে একটা বৃহত্ত্ব এবং বল লাভ করা যায় তাহাকে লোকে শ্রদ্ধা না করিয়া থাকিতে পারে না । শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিতে না পারিলে সুবিচার আকর্ষণ করা বড়ো কঠিন । কিন্তু বালির বঁাধ বাধিবে কী করিয়া । যাহারা বারম্বার নিহত পরাহত হইয়াছে, অথচ কোনোকালে সংহত হইতে শিখে নাই, যাহাদের সমাজের মধ্যে অনৈক্যের সহস্ৰ বিষবীজ নিহিত রহিয়াছে, তাহাদিগকে কিসে বঁাধিতে পরিবে । ইংরাজ যে আমাদের মৰ্মবেদনা অনুভব করিতে পারে না এবং ইংরাজ ঔষধের দ্বারা চিকিৎসার চেষ্টা না করিয়া কঠিন আঘাতের দ্বারা আমাদের হৃদয়ব্যথা চতুরগুণ বর্ধিত করিবার উদযোগ করিতেছে, এই বিশ্বাসে উত্তর হইতে দক্ষিণে এবং পূর্ব হইতে পশ্চিমে সমস্ত যথেষ্ট নহে। আমাদের স্বজাতি এখনাে আমাদের স্বজাতীয়ের পক্ষে ধ্রুব আশ্রয়ভূমি হইয়া উঠিতে পারেন নাই। এইজন্য বাহিরের ঝটিকা অপেক্ষা আমাদের গৃহভিত্তির বালুকাময় প্রতিষ্ঠা-স্থানকে অধিক আশঙ্কা করি। খরবেগ নদীর মধ্যস্রোত অপেক্ষা তাহার শিথিলবন্ধন ভঙ্গপ্রবণ তটভূমিকে পরিহার করিয়া চলিতে হয় । আমরা জানি, বহুকাল পরাধীনতায় পিষ্ট হইয়া আমাদের জাতীয় মনুষ্যত্ব ও সাহস চুৰ্ণ হইয়া গেছে। আমরা জানি যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি দণ্ডায়মান হইতে হয় তবে সর্বাপেক্ষা ভয় আমাদের স্বজাতিকে । যাহার হিতের জন্য প্রাণপণ করা যাইবে সেই আমাদের প্রধান বিপদের কারণ ; আমরা যাহার সহায়তা করিতে যাইব তাহার নিকট হইতে সহায়তা পাইব না- কাপুরুষগণ সত্য অস্বীকার করিবে, নিপীড়িতগণ আপন পীড়া গোপন করিয়া যাইবে, আইন আপনি বজমুষ্টি প্রসারিত করিবে এবং জেলখানা আপন লীেহবন্দন ব্যাদান করিয়া আমাদিগকে গ্ৰাস করিতে আসিবে। কিন্তু তথাপি আকৃত্রিম মহত্ত্ব এবং স্বাভাবিক ন্যায়প্রিয়তা -বশত আমাদের মধ্যে দুই-চারিজন লোকও যখন শেষ পর্যন্ত অটল থাকিতে পরিবে তখন আমাদের জাতীয় বন্ধনের সূত্রপাত হইতে থাকিবে এবং তখন আমরা ন্যায়বিচার পাইবার অধিকার প্রাপ্ত হইব । জানি না। হিন্দু ও মুসলমানের বিরোধ অথবা ভারতবষীয় ও ইংরাজের সংঘর্ষস্থলে আমরা যাহা অনুমান ও অনুভব করিয়া থাকি তাহা সত্য কি না, আমরা যে অবিচারের আশঙ্কা করিয়া থাকি তাহা সমূলক কি না ; কিন্তু ইহা নিশ্চয় জানি যে, কেবলমাত্র বিচারকের অনুগ্রহ ও কর্তব্য বুদ্ধির উপর বিচারভার রাখিয়া দিলে সুবিচারের অধিকারী হওয়া যায় না। রাজতন্ত্র যতই উন্নত হউক, প্রজার অবস্থা নিতান্ত অবনত হইলে সে কখনোই আপনাকে উচ্চে ধারণ করিয়া রাখিতে পারে না । কারণ, মানুষের দ্বারাই রাজ্য চলিয়া থাকে, যন্ত্রের দ্বারাও নহে, দেবতার দ্বারাও নহে। তাহদের নিকট যখন আমরা আপনাদিগকে মনুষ্য বলিয়া প্রমাণ দিব তখন তাহারা সকল সময়েই আমাদের সহিত মনুষ্যোচিত ব্যবহার করিবে । যখন ভারতবর্ষে অন্তত কতকগুলি লোকও উঠিবেন যাহারা আমাদের মধ্যে আটল সত্যপ্রিয়তা ও নিভীক ন্যায়পরতার উন্নত আদর্শ স্থাপন করিবেন, যখন ইংরাজ অন্তরের সহিত অনুভব করিবে যে, ভারতবর্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চেষ্টভাবে গ্রহণ করে না, সচেষ্টভাবে প্রার্থনা করে, অন্যায় নিবারণের জন্য প্ৰাণপণ করিতে প্ৰস্তুত হয়, তখন তাহারা কখনো ভ্ৰমেও আমাদিগকে অবহেলা করিবে না এবং আমাদের প্রতি ন্যায়বিচারে শৈথিল করিতে তাহদের স্বভাবতই প্রবৃত্তি হইবে না। Y\90Y