পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V SVEGF &c.) না । কিন্তু ভক্তির সম্বন্ধ হৃদয়ের সম্বন্ধ ; সে সম্বন্ধে দান-প্রতিদান আছে- তাহা কলের সম্বন্ধ নহে । সে সম্বন্ধ স্থাপন করিতে গেলেই কাছে আসিতে হয়, তাহা শুদ্ধমাত্র জবরদস্তির কর্ম নহে। কিন্তু কাছেও ঘোষিব না, হৃদয়ও দিব না, অথচ রাজভক্তিও চাই। শেষকালে সেই ভক্তি সম্বন্ধে যখন সন্দেহ জন্মে। তখন গুখ লাগাইয়া, বেত চালাইয়া, জেলে দিয়া ভক্তি আদায় করিতে ইচ্ছা হয় । ইংরেজ শাসনের কল চালাইতে চালাইতে হঠাৎ এক-একবার রাজভক্তির জন্য ব্যগ্ৰ হইয়া উঠেন, কার্জনের আমলে তাহার একটা নমুনা পাওয়া গিয়াছিল। স্বাভাবিক। আভিজাত্যের অভাবে লর্ড কার্জন কর্তৃত্বের নেশায় উন্মত্ত হইয়াছিলেন, তাহা স্পষ্ট অনুভব করা গিয়াছিল। এ গদি ছাড়িতে র্তাহার কিছুতেই মন সরিতেছিল না। এই রাজকীয় আড়ম্বর হইতে অবসৃত হইয়া তাহার অন্তরাত্মা ‘খোয়ারি-গ্ৰস্ত মাতালের মতো আজ যে অবস্থায় আছে তাহা যদি আমরা যথার্থভাবে অনুভব করিতাম। তবে বাঙালিও বোধ হয় আজ তাহাকে দয়া করিতে পারিত। এরূপ আধিপত্যলোলুপতা বোধ করি ভারতবর্ষের আর-কোনো শাসনকর্তা এমন করিয়া প্ৰকাশ করেন। নাই। এই লাটসাহেবটি ভারতবর্ষের পুরাতন বাদশাহের ন্যায় দরবার করিবেন স্থির করিলেন, এবং : স্পর্ধাপূর্বক দিল্লিতে সেই দরবারের স্থান করিলেন। কিন্তু প্ৰাচ্যরাজামাত্রই বুঝিতেন, দরবার স্পর্ধাপ্রকাশের জন্য নহে ; দরবার রাজার সহিত প্রজাদের । আনন্দসম্মিলনের উৎসব । সেদিন কেবল রাজ্যোচিত ঐশ্বর্যের দ্বারা প্ৰজাদিগকে স্তম্ভিত করা নয়, সেদিন রাজ্যোচিত ঔদার্যের দ্বারা তাহাদিগকে নিকটে আহবান করিবার দিন । সেদিন ক্ষমা করিবার, দান করিবার, রাজশাসনকে সুন্দর করিয়া সাজাইবার শুভ অবসর। কিন্তু পশ্চিমের হঠাৎ নবাব দিল্লির প্রাচ্য-ইতিহাসকে সম্মুখে রাখিয়া এবং বদান্যতাকে সওদাগরি কাপিণ্য-দ্বারা খর্ব করিয়া কেবল প্ৰতাপকেই উগ্রতর করিয়া প্ৰকাশ করিলেন । ইহাতে বস্তুত ইংরাজের রাজশ্ৰী আমাদের কাছে গৌরব লাভ করে নাই। ইহাতে দরবারের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ব্যর্থ হইয়া গেছে। এই দরবারের দুঃসহ দৰ্পে প্রাচ্যহাদয় পীড়িত হইয়াছে, লেশমাত্র আকৃষ্ট হয় নাই। সেই প্রচুর অপব্যয় যদি কিছুমাত্র ফল রাখিয়া থাকে, তবে তাহা অপমানের স্মৃতিতে। লোহার কাঠির দ্বারা সোনার কাঠির কােজ সারিবার চেষ্টা যে নিম্ফল তাহা নহে, তাহাতে উলটা ফল হইয়া থাকে । এবারে রাজপুত্রকে ভারতবর্ষে আনা হইল। রাজনীতির তরফ হইতে পরামর্শ উত্তম হইয়াছে। কারণ, সাধারণত রাজবংশীয়ের প্রতি ভারতবষীয় হৃদয়ের অভিমুখিতা বহুকালের প্রকৃতিগত । সেইজন্য দিল্লির দরবারে ডুক অফ কনট থাকিতে কার্জনের দরবার তক্ত-গ্ৰহণ ভারতবষীয়মাত্রকেই বাজিয়াছিল। এরূপ স্থলে ড্রাকের উপস্থিত থাকাই উচিত ছিল না। বস্তুত প্ৰজাগণের ধারণা হইয়াছিল যে, কার্জন নিজের দম্ভ প্রচার করিবার জন্যই ইচ্ছাপূর্বক দরবারে ডুক অব কনটের উপস্থিতি ঘটাইয়াছিলেন। আমরা বিলাতি কায়দা বুঝি না, বিশেষত দরবার-ব্যাপারটাই যখন বিশেষভাবে প্রাচ্য তখন এ উপলক্ষে রাজবংশের প্রকাশ্য অবমাননা অন্তত পলিসি-সংগত হয় নাই । যাই হােক, ভারতবর্ষের রাজভক্তিকে নাড়া দিবার জন্য একবার রাজপুত্রকে সমস্ত দেশের উপর দিয়া বুলাইয়া লওয়া উচিত- বোধ করি এইরূপ পরামর্শ হইয়া থাকিবে । কিন্তু ভারতবর্ষের ইংরেজ হৃদয়ের কারবার কোনোদিন করে নাই। তাহারা এ দেশকে হৃদয় দেয়ও নাই, এ দেশের হৃদয় চায়ও নাই, দেশের হৃদয়টা কোথায় আছে তাহার খবরও রাখে না। ইহারা রাজপুত্রের ভারতবর্ষে আগমন-ব্যাপারটাকে যত স্বল্পফলপ্রদ করা সম্ভব তাহা করিল। আজ রাজপুত্র ভারতবর্ষের মাটি । ছাড়িয়া জাহাজে উঠিতেছেন, আর আমাদের মনে হইতেছে যেন একটা স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল, যেন একটা শুরু শেষ হল। ক্সিই হইল ন—মনে রবিবার কিছুরইল না, যাহা যেন ছিল তাহা তেমনি গেল । ভারতবর্ষের রাজভক্তি প্রকৃতিগত, এ কথা সত্য। হিন্দু-ভারতবর্ষের রাজভক্তির একটু বিশেষত্ব আছে। হিন্দুরা রাজাকে দেবতুল্য ও রাজভক্তিকে ধর্মস্বরূপে গণ্য করিয়া থাকেন। পাশ্চাত্যগণ এ কথার যথার্থ মর্ম গ্ৰহণ করিতে পারেন না । তঁহারা মনে করেন, ক্ষমতার কাছে এইরূপ অবনত হওয়া