পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমাদের স্বাভাবিক দীন চরিত্রের পরিচয় । সংসারের অধিকাংশ সম্বন্ধকেই হিন্দু দৈবসম্বন্ধ না মনে করিয়া থাকিতে পারে না। হিন্দুর কাছে প্রায় কিছুই আকস্মিক সম্বন্ধ নহে। কারণ, হিন্দু জানে, আমাদের কাছে প্রকাশ যতই বিচিত্র ও বিভিন্ন হউক না, মূলশক্তি একই। ভারতবর্ষে ইহা কেবলমাত্র একটা দার্শনিক তত্ত্ব নহে, ইহা ধৰ্ম— ইহা পুঁথিতে লিখিবার, কলেজে পড়াইবার নহে— ইহা জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে উপলব্ধি ও জীবনের সতী স্ত্রীকে লক্ষ্মী বলি। গুরুজনকে পূজা করিয়া আমরা ধর্মকে তৃপ্ত করি। ইহার কারণ, যে-কোনো সম্বন্ধের মধ্য হইতে আমরা মঙ্গললাভ করি সেই সম্বন্ধের মধ্যেই আমরা আদি মঙ্গলশক্তিকে স্বীকার করিতে চাই। সেই সকল উপলক্ষ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া মঙ্গলময়কে সুদূর স্বর্গে স্থাপনপূর্বক পূজা করা ভারতবর্ষের ধর্ম নহে। পিতামাতাকে যখন আমরা দেবতা বলি তখন এ মিথ্যাকে আমরা মনে স্থান দিই না যে, তাহারা বিশ্বভুবনের ঈশ্বর বা তঁহাদের অলৌকিক শক্তি আছে। র্তাহাদের দৈন্য দুর্বলতা, র্তাহাদের মনুষ্যত্ব সমস্তই আমরা নিশ্চিত জানি, কিন্তু ইহাও সেইরূপ নিশ্চিত জানি যে, ইহারা পিতামাতারূপে আমাদের যে কল্যাণ সাধন করিতেছেন সেই পিতৃমাতৃত্ব জগতের পিতামাতারই প্রকাশ। ইন্দ্ৰ চন্দ্ৰ অগ্নি বায়ুকে যে বেদে দেবতা বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে তাহারও এই কারণ। শক্তিপ্রকাশের মধ্যে ভারতবর্ষ শক্তিমান পুরুষের সত্তা অনুভব না করিয়া কোনোদিন তৃপ্ত হয় নাই । এইজন্য বিশ্বভুবনে নানা উপলক্ষে নানা আকারেই ভক্তিবিনম্র ভারতবর্ষের পূজা সমাহৃত হইয়াছে। জগৎ আমাদের নিকট সর্বদাই দেবশক্তিতে সজীব । এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা যে, আমরা দীনতাবশতই প্রবলতার পূজা করিয়া থাকি। সকলেই জানে, গাভীকেও ভারতবর্ষ পূজ্য করিয়াছে। গাভী যে পশু তাহা সে জানে না ইহা নহে। মানুষ প্রবল এবং গাভীই দুর্বল। কিন্তু ভারতবষীয় সমাজ গাভীর নিকট হইতে নানাপ্রকার মঙ্গল লাভ করে । সেই মঙ্গল মানুষ যে নিজের গায়ের জোরে পশুর কােছ হইতে আদায় করিয়া লইতেছে এই ঔদ্ধত্য ভারতবর্ষের নহে। সমস্ত মঙ্গলের মূলে সে দৈব অনুগ্রহকে প্ৰণাম করিয়া সকলের সঙ্গে আত্মীয়সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারিলে তবে বঁাচে । কারিকর তাহার যন্ত্রকে প্ৰণাম করে, যোদ্ধা তাহার তরবারিকে প্ৰণাম করে, গুণী তাহার বীণাকে প্ৰণাম করে । ইহারা যে যন্ত্রকে যন্ত্র বলিয়া জানে না। তাহা নহে ; কিন্তু ইহাও জানে, যন্ত্র একটা উপলক্ষমাত্র- যন্ত্রের মধ্য হইতে সে যে আনন্দ বা উপকার লাভ করিতেছে তাহা কাঠ বা লোহার দান নহে ; কারণ, আত্মাকে আত্মীয় ছাড়া কোনো সামগ্ৰীমাত্রে স্পর্শ করিতে পারে না । এইখন সুস্থােনর কৃতজ্ঞতা, তাহদের পূজা, যিনি বিষয়ের বন্ধ গুহার নিকট এই প্ৰযোেগই হয় । এই ভারতবর্ষ রাজশাসন-ব্যাপারকে যদি পুরুষরূপে নহে, কেবল যন্ত্ররূপে অনুভব করিতে থাকে, তবে তাহার পক্ষে এমন পীড়াকর আর-কিছুই হইতে পারে না । জড়ের মধ্যেও আত্মার সম্পর্ক অনুভব করিয়া। তবে যাহার তৃপ্তি হয়, রাষ্ট্ৰতন্ত্রের মতো এতবড়ো মানব-ব্যাপারের মধ্যে সে হৃদয়ের প্রত্যক্ষ আবির্ভাবকে মূর্তিমান না দেখিয়া বঁাচে কিরূপে । আত্মার সঙ্গে আত্মীয়ের সম্বন্ধ যেখানে আছে সেখানেই নত হওয়া যায় ; যেখানে তাহা নাই সেখানে নত হইতে অহরহ বাধ্য হইলে অপমান ও পীড়া বোধ হয়। অতএব রাষ্ট্রব্যাপারের মধ্যস্থলে আমরা দেবতার শক্তিকে, মঙ্গলের প্রত্যক্ষস্বরূপকে রাজরূপে দেখিতে পাইলে শাসনের বিপুল ভার সহজে বহন করিতে পারি ; নাহিলে হৃদয় প্রতিক্ষণেই ভাঙিয়া যাইতে থাকে। আমরা পূজা করিতে চাই- রাজতন্ত্রের মধ্যে প্রাণপ্ৰতিষ্ঠা করিয়া তাহার সুগ্ৰহ্মদের প্রাগের যোগ অনুভব করতে চাই—আমরা বলকে কেবলমাত্র কারণে সহ্য করতে न् । অতএব ভারতবর্ষের রাজভক্তি প্রকৃতিগত। এ কথা সত্য। কিন্তু সেইজন্য রাজা তাহার পক্ষে শুদ্ধমাত্র তামাশার রাজা নহে। রাজাকে সে একটা অনাবশ্যক আড়ম্বরের অঙ্গরূপে দেখিতে ভালোবাসে না। সে রাজাকে যথার্থ সত্যরূপে অনুভব করিতেই ইচ্ছা করে। সে রাজাকে