পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

$sT STSF) ه وي\O কাজ করাইতে হইবে, না মাতাল করিতেই হইবে ? যে পরিমাণ মদে ক্ষীণ প্ৰাণকে কাজের উপযোগী করিয়া তোলে তাহার চেয়ে বেশি মদে পুনশ্চ অহার কাজের উপযোগিতা নষ্ট করিয়া দেয় ; যে-সকল সত্যকর্মে ধৈর্য এবং অধ্যবসায়ের প্রয়োজন সে কাজে মাতালের শক্তি এবং অভিরুচি বিমুখ হইয়া। উঠে । ক্রমে উত্তেজনাই তাহার লক্ষ্য হয় এবং সে দায়ে পড়িয়া কাজের নামে এমন সকল অকাজের সৃষ্টি করিতে থাকে যাহা তাহার মত্ততারই আনুকুল্য করিতে পারে। এই সকল উৎপাত-ব্যাপারকে বস্তুত তাহারা মাদকস্বরূপেই ব্যবহার করে, অথচ তাহাকে স্বদেশহিত নাম দিয়া উত্তেজনাকে উচ্চসুরেই বাধিয়া রাখে। ‘হৃদয়বেগ' জিনিসটা উপযুক্ত কাজের দ্বারা বহিরমুখ না হইয়া যখন কেবলই অন্তরে সঞ্চিত ও বধিত হইতে থাকে, তখন তাহা বিষের মতো কাজ করে ; তাহার অপ্রয়োজনীয় উদ্যম আমাদের স্নায়ুমণ্ডলকে বিকৃত করিয়া কৰ্মসভাকে নৃত্যসভা করিয়া তোলে। ঘুম হইতে জাগিয়া নিজের সচল শক্তিকে সত্য বলিয়া জানিবার জন্য প্রথম যে-একটা উত্তেজনার আঘাত আবশ্যক তাহাতে আমাদের প্রয়োজন ছিল । মনে নিশ্চয় স্থির করিয়াছিলাম, ইংরেজ জন্মান্তরের সুকৃতি এবং জন্মকালের শুভগ্ৰহস্বরূপ আমাদের কর্মহীন জোড়কারপুটে আমাদের সমস্ত মঙ্গল আপনি তুলিয়া দিবে। বিধাতা-নির্দিষ্ট আমাদের সেই বিনা চেষ্টার সৌভাগ্যকে কখনো-বা বন্দনা করিতাম, কখনো-বা তাহার সঙ্গে কলহ করিয়া কাল কাটাইতাম । এই করিতে করিতে মধ্যাহ্নকালে যখন সমস্ত জগৎ আপিস করিতেছে তখন আমাদের সুখনিদ্ৰা প্রগাঢ় হইতেছিল। এমন সময় কোথা হইতে একটা আঘাত লাগিল, ঘুমের ঘোরও কাটিল- আগেকার মতো পুনশ্চ সুখস্বপ্ন দেখিবার জন্য নয়ন মুদিবার ইচ্ছাও রহিল না ; কিন্তু আশ্চর্য এই, আমাদের সেই স্বপ্নের সঙ্গে জাগরণের একটা বিষয়ে মিল রহিয়াই গেল । তখন আমরা নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলাম যে, চেষ্টা না করিয়াই আমরা চেষ্টার ফল পাইতে থাকিব ; এখনো ভাবিতেছি, ফল পাইবার জন্য প্রচলিত পথে চেষ্টাকে খাটাইবার প্রয়োজন আমরা যেন যথেষ্ট সংক্ষিপ্ত করিয়া লইতে পারি। স্বপ্নবস্থাতেও অসম্ভবকে আঁকড়িয়া পড়িয়া ছিলাম, জাগ্রত অবস্থাতেও সেই অসম্ভবকে ছাড়িতে পারিলাম না। শক্তির উত্তেজনা আমাদের মধ্যে অত্যন্ত বেশি হওয়াতে অত্যাবশ্যক বিলম্বকে অনাবশ্যক বোধ হইতে লাগিল। বাহিরে সেই চিরপুরাতন দৈন্য রহিয়া গিয়াছে, অথচ অন্তরে নবজাগ্ৰত শক্তির অভিমান মাথা তুলিয়াছে ; উভয়ের সামঞ্জস্য করিব কী করিয়া। ধীরে ধীরে ? ক্রমে ক্ৰমে ? মাঝখানের প্রকাণ্ড গহবরটাকে পাথরের সেতু দিয়া বাধিয়া ? কিন্তু অভিমান দেরি সহিতে পারে না ; মত্ততা বলে, আমার সিঁড়ির দরকার নাই, আমি উড়িব । সময় লইয়া সুসাধ্যসাধন তো সকলেই পারে, অসাধ্যসাধনে আমরা এখনই জগৎকে চমক লাগাইয়া দিব এই কল্পনা আমাদের উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছে। তাহার কারণ, প্রেম যখন জাগে তখন সে গোড়া হইতে সকল কাজই করিতে চায়, সে ছোটাে হইতে বড়ো কিছুকেই অবজ্ঞা করে না, কোনো কর্তব্য পাছে অসমাপ্ত থাকে এই আশঙ্কা তাহার ঘুচে না । প্রেম নিজেকে সার্থক করিতেই চায়, সে নিজেকে প্রমাণ করিবার জন্য ব্যস্ত নহে। কিন্তু অপমানের তাড়নায় কেবল আত্মাভিমান মাত্র যখন জাগিয়া উঠে তখন সে বুক ফুলাইয়া বলে, “আমি হঁটিয়া চলিব না, আমি ডিঙাইয়া চলিব।’ অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য সকলের পক্ষেই । যাহা খাটে তার পক্ষে তাহার কোনো প্রয়োজন নাই ;ধৈর্যের প্রয়োজন নাই, অধ্যবসায়ের প্রয়োজন নাই ; সুদূর উদ্দেশ্যকে লক্ষ্য করিয়া সুদীর্ঘ উপায় অবলম্বন করা অনাবশ্যক। ফলে দেখিতেছি, পরের তেমনি অন্ধ প্ৰত্যাশা লইয়া আস্ফালন করিতেছি । তখনো যথাবিহিত কর্মকে ফাকি দিবার চেষ্টা ছিল, এখনো সেই চেষ্টাই বর্তমান । কথামালার কৃষকের নিশ্চেষ্ট ছেলেরা যতদিন বাপ বাচিয়া ছিল খেতের ধারেও যায় নাই । বাপ চাষ করিত, তাহারা দিব্য খাইত । বাপ যখন মরিল তখন খেতে নামিতে বাধ্য হইল ; কিন্তু চাষ করিবার জন্য নহে-তাহারা স্থির করিল, মাটি খুঁড়িয়া একেবারেই দৈবাধন পাইবে। বস্তুত চাষের ফসলই যে প্রকৃত দৈবাধন এ কথা শিখিতে তাহাদিগকে অনেক বৃথা সময় নষ্ট করিতে হইয়াছিল। আমরাও যদি এ কথা সহজে না শিখি যে, দৈবাধন কোনো অদ্ভুত উপায়ে গোপনে পাওয়া