পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা \ዓፄ 8 অন্ধতা বা চাতুরীর জোরে বাস্তবকে লঙ্ঘন করিয়া আমরা অতি ছােটাে কাজটুকুও করিতে পারি না। অতএব দেশহিতের সংকল্প সম্বন্ধে যখন আমরা তর্ক করি তখন সেই তর্কের একটি প্রধান কথা এই যে, সংকল্পটি যতই বড়ো হােক এবং যতই ভালো হােক, বাস্তবের সঙ্গে তাহার সামঞ্জস্য আছে কি না । কোন ব্যক্তির চেক-বহির পাতায় কতগুলা অঙ্ক পড়িয়াছে তাহা লইয়াই তাড়াতাড়ি উৎসাহ করিবার কারণ নাই, কোন ব্যক্তির চেক ব্যাঙ্কে চলে তাহাঁই দেখিবার বিষয় । সংকটের সময় যখন কাহাকেও পরামর্শ দিতে হইবে তখন এমন পরামর্শ দিলে চলে না যাহা অত্যন্ত সাধারণ । কেহ যখন রিক্তপাত্ৰ লইয়া মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে থাকে কেমন করিয়া তাহার পেট ভরিবে তখন তাহাকে এই কথাটি বলিলে তাহার প্রতি হিতৈষিতা প্ৰকাশ করা হয় না যে, ভালো করিয়া অন্নপান করিলেই ক্ষুধানিবৃত্তি হইয়া থাকে। এই উপদেশের জন্যই সে এতক্ষণ কপালে হাত দিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়া ছিল না । সত্যকার চিন্তার বিষয় যেটা সেটাকে লঙ্ঘন করিয়া যতবড়ো কথাই বলি-না কেন, তাহা একেবারেই বাজে কথা । . ভারতবর্ষের সম্বন্ধেও প্রধান প্রয়োজনটা কী সে কথা আলোচনা উপলক্ষে আমরা যদি তাহার বর্তমান বাস্তব অভাব ও বাস্তব অবস্থাকে একেবারেই চাপা দিয়া একটা খুব মস্ত নীতিকথা বলিয়া বসি তবে শূন্য তহবিলের চেকের মতো সে কথার কোনো মূল্য নাই ; তাহা উপস্থিতমত ঋণের দাবি শান্ত করিবার একটা কৌশলমাত্র হইতে পারে। কিন্তু পরিণামে তাহা দেনাদার বা পাওনাদার কাহারও পক্ষে কিছুমাত্র কল্যাণকর হইতে পারে না । ‘পথ ও পাথেয়' প্ৰবন্ধে আমি যদি সেইরূপ ফাকি চালাইবার চেষ্টা করিয়া থাকি তবে বিচার-আদালতের ক্ষমা প্রত্যাশা করিতে পারিব না । আমি যদি বাস্তবকে গোপন বা অস্বীকার করিয়া কেবল একটা ভাবের ভুয়া দলিল গড়িয়া থাকি তবে সেটাকে সর্বসমক্ষে খণ্ডবিখণ্ড করাই কর্তব্য । কারণ, ভাব যখন বাস্তবের সহিত বিচ্ছিন্ন হইয়া দেখা দেয় তখন গাজা বা মদের মতো তাহা মানুষকে অকৰ্মণ্য এবং উদভ্ৰান্ত করিয়া তোলে। কিও বিশেষ অবস্থায় কোনটা যে প্রকৃত বাস্তব তাহা নির্ণয় করা সোজা নহে। সেইজন্যই অনেক সময় মানুষ মনে করে, যেটাকে চােখে দেখা যায় সেটাই সকলের চেয়ে বড়ো বাস্তব ; যেটা মানবপ্রকৃতির নীচের তলায় পড়িয়া থাকে সেটাই আসল সত্য। কোনো ইংরাজী-সাহিত্যসমালোচক রামায়ণের অপেক্ষা ইলিয়ডের শ্রেষ্ঠতা প্ৰমাণ করিবার কালে বলিয়াছেন, ইলিয়ড কাব্য অধিকতর হিউম্যান, অর্থাৎ মানবচরিত্রের বাস্তবকে বেশি করিয়া স্বীকার করিয়াছে- কারণ, উক্ত কাব্যে একিলিস নিহত শত্রুর মৃতদেহকে রথে বাধিয়া ট্রয়ের পথের ধুলায় লুটাইয়া বেড়াইয়াছেন, আর রামায়ণে রাম পরাজিত শত্রুকে ক্ষমা করিয়াছেন । ক্ষমা অপেক্ষা প্ৰতিহিংসা মানবচরিত্রের পক্ষে অধিকতর বাস্তব এ কথার অর্থ যদি এই হয় যে, তাহা পরিমাণে বেশি। তবে তাহা স্বীকার করা যাইতে পারে। কিন্তু স্কুল পরিমাণই বাস্তবতা-পরিমাপের একমাত্র বাটখারা এ কথা মানুষ কোনােদিনই স্বীকার করিতে পারে না ; এইজন্যই মানুষ ঘর-ভরা অন্ধকারের চেয়ে ঘরের কোণের একটি ক্ষুদ্র শিখাকেই বেশি মান্য করিয়া থাকে । -: যাহাই হউক, এ কথা সত্য যে, মানব-ইতিহাসের বহুতর উপকরণের মধ্যে কোনটা প্রধান কোনটা অপ্রধান, কোনটা বর্তমানের পক্ষে একান্ত বাস্তব এবং কোনটা নহে, তাহা একবার কেবল চোখে দেখিয়াই মীমাংসা করা যায় না। অবশ্য এ কথা স্বীকার করিতে পারি, উত্তেজনার সময় উত্তেজনােটাকেই সকলের চেয়ে বড়ো সত্য বলিয়া মনে হয় । রাগের সময় এমন কোনো কথাকেই বাস্তবমূলক বলিয়া মনে হয় না। যাহা রাগকে নিবৃত্ত করিবার জন্য দণ্ডায়মান হয়। এরূপ সময় মানুষ সহজেই বলিয়া উঠে, ‘রেখে দাও তোমার ধর্মকথা ’ বলে যে, তাহার কারণ এ নয় যে, ধর্মকথাটাই বাস্তব প্রয়োজনের পক্ষে অযোগ্য এবং রুষ্ট বুদ্ধিই তদপেক্ষা উপযোগী। কিন্তু তাহার কারণ এই যে, বাস্তব উপযোগিতার প্রতি আমি দৃকপাত করিতে চাই না ; বাস্তব প্রবৃত্তি-চরিতার্থতাকেই আমি মান্য করিতে চাই ।