পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজা প্ৰজা Wጏbr\© কোনোমতেই মিলিতে চায় না, তাহাদিগকে একত্রে থাকিতে হইল । এমন ভাবে কেবল বোঝা তৈরি হয়, কিন্তু কিছুতেই দেহ বাধিয়া উঠিতে চায় না। তাই এই বোঝা ঘাড়ে করিয়াই ভারতবর্ষকে শত শত বৎসর ধরিয়া কেবলই চেষ্টা করিতে হইয়াছে, যাহারা বিচ্ছিন্ন কী উপায়ে সমাজের মধ্যে তাহারা সহযোগীরূপে থাকিতে পারে ; যাহারা বিরুদ্ধ কী উপায়ে তাহাদের মধ্যে সামঞ্জস্যরক্ষা করা সম্ভব হয় ; যাহাদের ভিতরকার প্রভেদ মানবপ্রকৃতি কোনোমতেই অস্বীকার করিতে পারে না, কিরূপ ব্যবস্থা করিলে সেই প্ৰভেদ যথাসম্ভব পরস্পরকে পীড়িত না করে- অর্থাৎ কী করিলে স্বাভাবিক ভেদকে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াও সামাজিক ঐক্যকে যথাসম্ভব মান্য করা যাইতে পারে । নানা বিভিন্ন লোক যেখানে একত্রে আছে সেখানকার প্রতিমুহূর্তের সমস্যাই এই যে, এই পার্থক্যের পীড়া এই বিভেদের দুর্বলতাকে কেমন করিয়া দূর করা যাইতে পারে। একত্রে থাকিতেই হইবে অথচ কোনোমতেই এক হইতে পারিব না, মানুষের পক্ষে এতবড়ো অমঙ্গল আর কিছুই হইতে পারে না । এমন অবস্থায় প্রথম চেষ্টা হয়, প্রভেদকে সুনির্দিষ্ট গণ্ডিদ্বারা স্বতন্ত্র করিয়া দেওয়া- পরম্পর পরস্পরকে আঘাত না করে সেইটি সামলাইয়া যাওয়া- পরস্পরের চিহ্নিত অধিকারের সীমা কেহ। কোনো দিক হইতে লঙ্ঘন না করে সেইরূপ ব্যবস্থা করা । কিন্তু এই নিষেধের গণ্ডিগুলি যাহা প্ৰথম অবস্থায় বহুবিচিত্ৰকে একত্রে অবস্থানে সহায়তা করে তাহাই কালক্রমে নানাকে এক হইয়া উঠিতে বাধা দিতে থাকে । তাহা আঘাতকেও বাচায়, তেমনি মিলনকেও ঠেকায় । অশান্তিকে দূরে খেদাইয়া রাখাই যে শান্তিকে প্রতিষ্ঠা করা তাহা নহে। বস্তুত তাহাতে অশাস্তিকে চিরদিনই কোনো-একটা জায়গায় জিয়াইয়া রাখা হয় ; বিরোধকে কোনোমতে দূরে রাখিলেও তবু তাহাকে রাখা হয়- ছাড়া পাইলেই তাহার প্রলয়মূর্তি হঠাৎ আসিয়া দেখা দেয়। শুধু তাই নয় । ব্যবস্থাবদ্ধভাবে একত্রে অবস্থানমাত্র মিলনের নেতিবাচক অবস্থা, ইতিবাচক নহে। তাহাতে মানুষ আরাম পাইতে পারে, কিন্তু শক্তি পাইতে পারে না। শৃঙ্খলার দ্বারা কাজ চলে মাত্র, ঐক্যের দ্বারা প্ৰাণ জাগে । ভারতবর্ষও এতকাল তাহার বহুতর অনৈক্য ও বিরুদ্ধতাকে একটি ব্যবস্থার মধ্যে টানিয়া প্রত্যেককে এক-একটি প্রকোষ্ঠে বদ্ধ করিবার চেষ্টাতেই নিযুক্ত ছিল । অন্য কোনো দেশেই এমন সত্যকার প্রভেদ একত্রে আসিয়া দাড়ায় নাই, সুতরাং অন্য কোনো দেশেরই এমন দুঃসাধ্যসাধনে প্ৰবৃত্ত হইবার কোনো প্রয়োজনই হয় নাই । 略 নানা বিশৃঙ্খল বিচ্ছিন্ন সত্য যখন স্তুপাকার হইয়া জ্ঞানের পথরোধ করিবার উপক্রম করে তখন বিজ্ঞানের প্রথম কাজ হয় তাহাদিগকে গুণকৰ্ম অনুসারে শ্রেণীবদ্ধ করিয়া ফেলা । কিন্তু, কি বিজ্ঞানে কি সমাজে, শ্রেণীবদ্ধ করা আরম্ভের কােজ ; কলেবরবদ্ধ করাই চূড়ান্ত ব্যাপার। ইটকাঠ চুনসুরকি পাছে বিমিশ্রিত হইয়া পরস্পরকে নষ্ট করে। এইজন্য তাহাদিগকে ভাগ ভাগ করিয়া সাজাইয়া রাখাই যে ইমারত নির্মাণ করা তাহা নহে । আমাদের দেশেও শ্রেণীবিভাগ হইয়া আছে, কিন্তু রচনাকার্য হয় আরম্ভ হয় নাই, নয়। অধিকদূর অগ্রসর হইতে পারে নাই। একই বেদনার অনুভূতির দ্বারা আদ্যোপােন্ত আবিষ্ট, প্রাণময় রসরক্তময় স্নায়ুপেশীমাংসের দ্বারা অস্থিরাশি যেমন করিয়া ঢাকা পড়ে তেমনি করিয়াই বিধিনিষেধের শুষ্ক কঠিন ব্যবস্থাকে একেবারে আচ্ছন্ন এবং অন্তরাল করিয়া দিয়া, যখন একই সরস অনুভূতির নাড়িজাল সমগ্রের মধ্যে প্ৰাণের চৈতন্যকে ব্যাপ্ত করিয়া দিবে তখনই জানিব মহাজাতি দেহধারণ করিয়াছে। আমরা যে-সকল দেশের ইতিহাস পড়িয়াছি তাহারা বিশেষ বিশেষ পথ দিয়া নিজের সিদ্ধির সাধনা করিয়াছে। যে বিশেষ অমঙ্গল তাঁহাদের পরিপূর্ণ বিকাশের অন্তরায় তাহারই সঙ্গে তাহাদিগকে লড়িতে হইয়াছে। একদিন আমেরিকার একটি সমস্যা এই ছিল যে, ঔপনিবেশিকদল এক জায়গায় আর তাহাদের চালকশক্তি সমুদ্রপারে, ঠিক যেন মাথার সঙ্গে ধড়ের বিচ্ছেদ- এরূপ অসমঞ্জস্য কোনো জাতির পক্ষে বহন করা অসম্ভব। ভূমিষ্ঠ শিশু যেমন মাতৃগর্ভের সঙ্গে কোনো বন্ধনে বাধা থাকিতে পারে না— নাড়ি ছেদন করিয়া দিতে হয়— তেমনি আমেরিকার সম্মুখে যেদিন এই নাড়ি-ছেদনের (88