পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ved 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী । আমি আপত্তি করিব না। কিন্তু সেইখানেই কি শেষ। আমাদের গরজ কি তাহার চেয়ে অনেক বেশি নহে। ঘরে আগুন লাগিলে কি পুলিসের থানাতে খবর পাঠাইয়া নিশ্চিন্ত থাকিবে । ইতিমধ্যে চােখের সামনে যখন স্ত্রীপুত্র পুড়িয়া মরিবে তখন দারোগার শৈথিল্য সম্বন্ধে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নালিশ করিবার জন্য বিরাট সভা আহবান করিয়া কি বিশেষ সন্তুনােলাভ করা যায়। আমাদের গরজ যে অত্যন্ত বেশি। আমরা যে মরিতেছি। আমাদের অভিমান করিবার, কলহ করিবার, অপেক্ষা করিবার আর অবসর নাই। যাহা পারি তাঁহাই করিবার জন্য এখনই আমাদিগকে কোমর বঁাধিতে হইবে । চেষ্টা করিলেই যে সকল সময়েই সিদ্ধিলাভ হয় তাহা না হইতেও পারে, কিন্তু কাপুরুষের নিস্ফলতা যেন না ঘটিতে দিই।- চেষ্টা না করিয়া যে ব্যর্থতা তাহা পাপ, তাহা কলঙ্ক । আমি বলিতেছি, আমাদের দেশে যে দুৰ্গতি ঘটিয়াছে তাহার কারণ আমাদের প্রত্যেকের অন্তরে, এবং তাহার প্রতিকার আমাদের নিজের ছাড়া আর কাহারও দ্বারা কোনোদিন সাধ্য হইতে পারে না। আমরা পরের পাপের ফলভোগ করিতেছি। ইহা কখনোই সত্য নহে, এবং নিজের পাপের প্রায়চিত্ত সুকৌশলে পরকে দিয়া করাইয়া লইব ইহাও কোনােমতে আশা করিতে পারি না। সৌভাগ্যক্রমে আজ দেশের নানা স্থান হইতে এই প্রশ্ন উঠিতেছে- ‘কী করিব, কেমন করিয়া করিব ।’ আজ আমরা কর্ম করিবার ইচ্ছা অনুভব করিতেছি, চেষ্টায়ও প্রবৃত্ত হইতেছি- এই ইচ্ছা! যাহাতে নিরাশ্রয় না হয়, এই চেষ্টা যাহাতে বিক্ষিপ্ত হইয়া না পড়ে, প্রত্যেকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তি যাহাতে বিচ্ছিন্ন-কণা-আকারে বিলীন হইয়া না যায়, আজ আমাদিগকে সেই দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হইবে। রেলগাড়ির ইস্টম উচ্চস্বরে বঁশি বাজাইবার জন্য হয় নাই, তাহা গাড়ি চালাইবার জন্যই হইয়াছে। বঁশি বাজাইয়া তাহা সমস্তটা ফুকিয়া দিলে ঘোষণার কাজটা জমে বটে, কিন্তু অগ্রসর হইবার কাজটা বন্ধ হইয়া যায়। আজ দেশের মধ্যে যে উদ্যম উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে তাহাকে একটা বেষ্টনের মধ্যে না আনিতে পারিলে তাহা নিজের মধ্যে কেবল বিরোধ করিতে থাকিবে, নুতন নূতন দলের সৃষ্টি সুপ্রিল সামরিক উদবেগের আকর্ষণ সুস্থ কাজকে বড়ো করিয়া তুলিয়া নিজের অপব্যয় अॉन का ! দেশের সমস্ত উদ্যমকে বিক্ষেপের ব্যর্থতা হইতে একের দিকে ফিরাইয়া আনিবার একমাত্র উপায় আছে- কোনো-একজনকে আমাদের অধিনায়ক বলিয়া স্বীকার করা । দশে মিলিয়া যেমন করিয়া বাদবিবাদ করা যায়, দশে মিলিয়া ঠিক তেমন করিয়া কাজ করা চলে না। ঝগড়া করিতে গেলে হট্টগোল করা সাজে, কিন্তু যুদ্ধ করিতে গেলে সেনাপতি চাই। কথা চালাইতে গেলে নানা লোকে মিলিয়া স্ব স্ব কণ্ঠস্বরকে উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তকে উৎক্ষিপ্ত করিবার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু জাহাজ চালাইতে গেলে একজন কাপ্তোনের প্রয়োজন | আজ অনুনয়সহকারে আমার দেশবাসিগণকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছি, আপনারা ক্রোধের দ্বারা আত্মবিস্মৃত হইবেন না, কেবল বিরোধ করিয়া ক্ষোভ মিটাইবার চেষ্টা করিবেন না । ভিক্ষা করিতে গেলেও যেমন পরের মুখাপেক্ষা করিতে হয়, বিরোধ করিতে গেলেও সেইরূপ পরের দিকে সমস্ত মন বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে । জয়ের পন্থা ইহা নহে। এ-সমস্ত সবলে উপেক্ষা করিয়া মঙ্গলসাধনের মহৎ গৌরব লইয়া আমরা জয়ী হইব । ) আপনারা ভাবিয়া দেখুন, বাংলার পটিশনটা আজ খুব একটা বড়ো ব্যাপার নহে। আমরা তাহাকে ছোটো করিয়া ফেলিয়াছি। কেমন করিয়া ছোটাে করিয়াছি। এই পাটিশনের আঘাত উপলক্ষে আমরা সমস্ত বাঙালি মিলিয়া পরম বেদনার সহিত স্বদেশের দিকে যেমনি ফিরিয়া চাহিলাম অমনি এই পাটিশনের কৃত্রিম রেখা ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্র হইয়া গেল। আমরা যে আজ সমস্ত মােহ কটাইয়া স্বহস্তে স্বদেশের সেবা করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাড়াইয়াছি, ইহার কাছে পাটিশনের আঁচড়টা কতই তুচ্ছ হইয়া গেছে। কিন্তু আমরা যদি কেবল পিটিশন ও প্রোটেস্ট, বয়কট ও বাচালতা লইয়াই থাকি,তাম, তবে এই পার্টিশনই বৃহৎ হইয়া উঠিত- আমরা ক্ষুদ্র হইতাম, পরাভূত হইতাম। কার্লাইলের শিক্ষা-সার্ক্সলর আজ কোথায় মিলাইয়া গেছে। আমরা তাহাকে নগণ্য করিয়া দিয়াছি। গালাগালি