পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ Ved Gł করিয়া নয়, হাতাহাতি করিয়াও নয়। গালাগালি-হাতাহাতি করিতে থাকিলে তো তাহাকে বড়ো করাই হইত। আজ আমরা নিজেদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করিতে উদ্যত হইয়াছি- ইহাতে আমাদের অপমানের দাহ, আমাদের আঘাতের ক্ষতযন্ত্রণা একেবারে জুড়াইয়া গেছে। আমরা সকল ক্ষতি সকল লাঞ্ছনার উপরে উঠিয়া গেছি। কিন্তু ঐ লইয়া যদি আজ পর্যন্ত কেবলই বিরাট সভার বিরাট ব্যর্থতায় দেশের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত ছুটিয়া বেড়াইতাম, আমাদের সানুনাসিক নালিশকে সমুদ্রের এ পার হইতে সমুদ্রের ও পার পর্যন্ত তরঙ্গিত করিয়া তুলিতাম, তবে ছোটােকে ক্রমাগতই আমাদের গােটাকতক মাথাও ভাঙিয়াছে এবং আমাদিগকে কিঞ্চিৎ দণ্ডও দিতে হইয়াছে, কিন্তু এই ব্যাপারটার উপরে বুক দিয়া পড়িয়া বেত্ৰহত বালকের ন্যায় আর্তনাদ করিতে থাকিলে আমাদের গৌরব নষ্ট হইবে । ইহার অনেক উপরে না উঠিতে পারিলে অশ্রুসেচনে কেবল লজ্জাই বাড়িয়া উঠিতে থাকিবে । উপরে উঠিবার একটা উপায়- আমরা র্যাহাকে নাযাকপদে বরণ করিব তাহাকে রাজ-অট্টালিকার তোরণদ্বার হইতে ফিরাইয়া আনিয়া আমাদের কুটিরপ্রাঙ্গণের পুণ্যবেদিকায় স্বদেশের ব্ৰতপতিরূপে অভিষিক্ত করা। ক্ষুদ্রের সঙ্গে হাতাহাতি করিয়া দিন-যাপনকেই জয়লাভের উপায় বলে না- তাহার চেয়ে উপরে ওঠাই জয় । আমরা আজ আমাদের স্বদেশের কোনো মনস্বীর কর্তৃত্ব যদি আনন্দের সহিত, গৌরবের সহিত স্বীকার করিতে পারি, তবে এমার্সন কবে আমাদের কার সহিত কী ব্যবহার করিয়াছে, কেম্পের আচরণ বেআইনি হইয়াছে কি না, তাহা তুচ্ছ হইতে তুচ্ছতর হইয়া সাময়িক ইতিহাসের ফলক হইতে একেবারে মুছিয়া যাইবে । বস্তুত এই ঘটনাকে অকিঞ্চিৎকর করিয়া না ফেলিলে আমাদের অপমান দূর হইবে না । স্বায়ত্তশাসন চিরদিনই আমাদের স্বায়ত্ত । ইংরেজ রাজা সৈন্য লইয়া পাহারা দিন, কৃষ্ণ বা রক্ত গাউন পরিয়া বিচার করুন, কখনো-বা অনুকূল কখনো-বা প্রতিকূল হউন, কিন্তু নিজের দেশের কল্যাণ নিজে করিবার যে স্বাভাবিক কর্তৃত্বঅধিকার তাহা বিলুপ্ত করিবার শক্তি কাহারও নাই। সে অধিকার নষ্ট আমরা নিজেরাই করি । সে অধিকার গ্রহণ যদি না করি তবেই তাহা হারাই | নিজের সেই স্বাভাবিক অধিকার হারাইয়া যদি কর্তব্যশৈথিল্যের জন্য অপরের প্রতি দোষারোপ করি তবে তাহা লজ্জার উপরে লজ্জা । মঙ্গল করিবার স্বাভাবিক সম্বন্ধ যাহাদের নাই, যাহারা দয়া করিতে পারে মাত্র, তাহদের নিকটই সমস্ত মঙ্গল, সমস্ত স্বার্থসংকোচ প্ৰত্যাশা করিব, আর নিজেরা ত্যাগ করিব না, কাজ করিব না, এরূপ দীনতার ধিক্কার অনুভব করা কি এতই কঠিন । তাই আমি বলিতেছি, স্বদেশের মঙ্গলসাধনের কর্তৃত্বসিংহাসন আমাদের সম্মুখে শূন্য পড়িয়া আমাদিগকে প্রতি মুহুর্তে লজ্জা দিতেছে। হে স্বদেশসেবকগণ, এই পবিত্র সিংহাসনকে ব্যর্থ করিয়ো না, ইহাকে পূর্ণ করো। রাজার শাসন অস্বীকার করিবার কোনাে প্রয়ােজন নাই— তাহা কখনাে শুভ কখনো অশুভ, কখনো সুখের কখনো অসুখের আকারে আমাদের উপর দিয়া প্রবাহিত হইয়া যাইবে কিন্তু আমাদের নিজের প্রতি নিজের যে শাসন তাঁহাই গভীর, তাহাই সত্য, তাহাই চিরস্থায়ী । সেই শাসনেই জাতি যথার্থ ভাঙে-গড়ে, বাহিরের শাসনে নহে। সেই শাসন অদ্য আমরা শাস্তসমাহিত পবিত্র চিত্তে গ্ৰহণ করিব। যদি তাহা গ্ৰহণ করি তবে প্রত্যেকে স্বস্বপ্রধান হইয়া অসংযত হইয়া উঠিলে চলিবে না । একজনকে মানিয়া আমরা যথার্থভাবে আপনাকে মানিব । একজনের মধ্যে আমাদের সকলকে স্বীকার করিব । একজনের দক্ষিণহস্তকে আমাদের সকলের শক্তিতে বলিষ্ঠ করিয়া তুলিব। আমাদের সকলের চিন্তা তাহার মন্ত্রণাগারে মিলিত হইবে এবং তাহার আদেশ আমাদের সকলের আদেশরূপে বাংলাদেশের ঘরে র্যাহারা পিটিশন বা প্রোটেস্ট, প্রণয় বা কলহ করিবার জন্য রাজবাড়ির বাধা রাস্তাটাতেই ঘন ঘন দৌড়াদৌড়ি করাকেই দেশের প্রধান কাজ বলিয়া গণ্য করেন। আমি সে দলের লোক নই। সে কথা