পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

°>心 রবীন্দ্র-রচনাবলী পুনশ্চ বলা বাহুল্য। আজ পর্যন্ত যাহারা দেশহিত-ব্ৰতীদের নায়কতা করিয়া আসিতেছেন তাহারা রাজপথের শুষ্ক বালুকায় অশ্রু ও ঘর্ম সেচন করিয়া তাহাকে উর্বরা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, তাহাও জানি । ইহাও দেখিয়াছি, মৎস্যবিরল জলে যাহারা ছিপ ফেলিয়া প্রত্যহ বসিয়া থাকে। অবশেষে তাহাদের, মাছ পাওয়া নয়, ঐ আশা করিয়া থাকাই একটা নেশা হইয়া যায়। ইহাকে নিঃস্বার্থ নিস্ফলতার নেশা বলা যাইতে পারে, মানবস্বভাবে ইহারও একটা স্থান আছে। কিন্তু এজন্য নায়কদিগকে দোষ দিতে পারি না, ইহা আমাদের ভাগ্যেরই দোষ । দেশের আকাঙক্ষা যদি মরীচিকার যাইতেন, তাহার বিরুদ্ধপথে চলিতে পারিতেন না । তবে নায়ক হইবার সার্থকতা কী, এ প্রশ্ন উঠিতে পারে । নায়কের কর্তব্য চালনা করা- ভ্রমের পথেই হউক, আর ভ্রম সংশোধনের পথেই হউক । অভ্রান্ত তত্ত্বদশীর জন্য দেশকে অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকিতে বলা কোনো কাজের কথা নহে। দেশকে চলিতে হইবে ; কারণ, চলা স্বাস্থ্যকর, বলকর । এতদিন আমরা যে পোলিটিকাল অ্যাজিটেশনের পথে চলিয়াছি তাহাতে অন্য ফললাভ যতই জড়ত্ব মোচন হইয়াছে। কখনোই উপদেশের দ্বারা ভ্রমের মূল উৎপাটিত হয় না, তাহা বারংবার অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতে থাকে। ভোগের দ্বারাই কর্মক্ষয় হয় ; তেমনি ভ্ৰম করিতে দিলেই যথার্থভাবে ভ্ৰমের সংশোধন হইতে পারে, নহিলে তাহার জড় মরিতে পারে না । ভুল করাকে আমি ভয় করি না, ভুলের আশঙ্কায় নিশ্চেষ্ট হইয়া থাকাকেই আমি ভয় করি। দেশের বিধাতা দেশকে বারংবার অপথে ফেলিয়াই তাহাকে পথ চিনাইয়া দেন- গুরুমহাশয় পাঠশালায় বসিয়া তাহাকে পথ চিনাইতে পারেন না। রাজপথে ছুটািছুটি করিয়া যতটা ফল পাওয়া যায় সেই সময়টা নিজের মাঠ চাষিয়া অনেক বেশি লাভের সম্ভাবনা, এই কথাটা সম্পূর্ণ বুঝিবার জন্য বহুদিনের বিফলতা গুরুর মতো কাজ করে । সেই গুরুর শিক্ষা যখন হৃদয়ংগম হইবে তখন, যাহারা পথে ছুটিয়াছিল তাহারাই মাঠে চলিবে ; আর যাহারা ঘরে পড়িয়া থাকে তাহারা বাটেরও নয়, মাঠেরও নয়, তাহারা অবিচলিত প্ৰজ্ঞতার ভড়ং করিলেও সকল আশার, সকল সদগতির বাহিরে । অতএব দেশকে চলিতে হইবে । চলিলেই তাহার সকল শক্তি আপনি জাগিবে, আপনি খেলিবে । কিন্তু রীতিমত চলিতে গেলে চালক চাই। পথের সমস্ত বিষ্ম অতিক্রম করিবার জন্য বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদিগকে দল বাধিতে হইবে, স্বতন্ত্র পাথেয়গুলিকে একত্ৰ করিতে হইবে, একজনের বাধ্যতা স্বীকার করিয়া দৃঢ় নিয়মের অধীনে নিজেদের মতবিভিন্নতাকে যথাসম্ভব সংযত করিতে হইবে- নতুবা আমাদের সার্থকতা-অন্বেষণের এই মহাযাত্রা দীর্ঘকাল কেবল ছুটাছুটি-দৌড়াদৌড়ি ডাকাডাকিইহাকাইকিতেই নষ্ট হইতে থাকিবে । > ○> ○ সভাপতির অভিভাষণ পাবনা প্ৰাদেশিক সম্মিলনী আদ্যকার এই মহাসভায় সভাপতির আসনে আহবান করিয়া আপনারা আমাকে যে সম্মান দান করিয়াছেন আমি তাহার অযোগ্য, এ কথার উল্লেখমাত্রও বাহুল্য। বস্তুত এরূপ সম্মান গ্ৰহণ করা সহজ, বহন করাই কঠিন। অযোগ্য লোককে উচ্চপদে বসানাে তাহাকে অপদস্থ করিবারই উপায়। অন্য সময় হইলে এতবড়ো দুঃসাধ্য দায়িত্ব হইতে নিস্কৃতিলাভের চেষ্টা করিতাম। কিন্তু বর্তমানে আমাদের আত্মবিচ্ছেদের সংকটকালে যখন ডাঙায় বাঘ ও জলে কুমির— যখন রাজপুরুষ কালপুরুষের মূর্তি ধরিয়াছেন এবং আত্মীয়সমাজেও পরস্পরের প্রতি কেহ ধৈর্য অবলম্বন করিতে