পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ \988 অখণ্ড সভা- বিয় ঘটিবামাত্রই সেই সমগ্রতাকেই যদি বিসর্জন দিতে উদ্যত হই। তবে কেবলমাত্র সভার সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া আমাদের এমনই কী লাভ হইবে। এ পর্যন্ত আমরা কোনো কাজ বা ব্যবসায় এমন-কি, আমাদের জন্য দল বাধিয়া, যখনই অনৈক্য ঘটিয়াছে তখনই ভিন্ন দলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছি। বিরোধ ঘটিবামাত্র আমরা মূল জিনিসটাকে হয় নষ্ট নয় পরিত্যাগ করিবার চেষ্টা করিয়াছি। বৈচিত্র্যকে ঐক্যের মধ্যে বাধিয়া তাহাকে নানা-অঙ্গ-বিশিষ্ট কলেবরে পরিণত করিবার জীবনীশক্তি আমরা দেখাইতে পারিতেছি না। আমাদের সমস্ত দুৰ্গতির কারণই তাই | কনগ্রেসের মধ্যেও যদি সেই রোগটা ফুটিয়া পড়ে, সেখানেও যদি উপরিতলে বিরোধের কিসের উপরে। যে সরষের দ্বারা ভূত ঝাড়াইব সেই সরষেকেই ভূতে পাইয়া বসিলে কী উপায়। বঙ্গবিভাগকে রহিত করিবার জন্য আমরা যেরূপ প্ৰাণপণে চেষ্টা করিয়াছি, এই আসন্ন আত্মবিভাগকে নিরস্ত করিবার জন্য আমাদিগকে তাহা অপেক্ষাও আরো বেশি চেষ্টা করিতে হইবে । পরের নিকট যে দুর্বল, আত্মীয়ের নিকট সে প্রচণ্ড হইয়া যেন নিজেকে প্রবল বলিয়া সাস্তুনা না পায় । পরে যে বিচ্ছেদ সাধন করে তাহাতে অনিষ্টমাত্র ঘটে, নিজে যে বিচ্ছেদ ঘটাই তাহাতে পাপ হয় ; এই পাপের অনিষ্ট অন্তরের গভীরতম স্থানে নিদারুণ প্ৰায়শ্চিত্তের অপেক্ষায় সঞ্চিত হইতে থাকে । আমাদের যে সময় উপস্থিত হইয়াছে এখন আত্মবিস্মৃত হইলে কোনোমতেই চলিবে না ; কারণ, এখন আমরা মুক্তির তপস্যা করিতেছি ; ইন্দ্ৰদেব আমাদের পরীক্ষার জন্য এই-যে তপোভঙ্গের উপলক্ষকে পাঠাইয়াছেন ইহার কাছে হার মানিলে আমাদের সমস্ত সাধনা নষ্ট হইয়া যাইবে । অতএব ভ্ৰাতৃগণ, যে ক্ৰোধে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই হাত তুলিতে চায় সে ক্ৰোধ দমন করিতেই হইবেআত্মীয়কৃত সমস্ত বিরোধকে বারংবার ক্ষমা করিতে হইবে, পরস্পরের অবিবেচনার দ্বারা যে সংঘাত ঘটিয়াছে তাহার সংশোধন করিতে ও তাঁহাকে ভুলিতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিলে চলিবে না। আগুন যখন আমাদের নিজের ঘরেই লাগিয়াছে তখন দুই পক্ষ দুই দিক হইতে এই অগ্নিকে উষ্ণবাক্যের বায়ুবীজন করিয়া ইহাকে প্রতিকারের অতীত করিয়া তুলিলে, তাহার চেয়ে মূঢ়তা আমাদের পক্ষে আর কিছুই হইতে পরিবে না। পরের কৃত বিভাগ লইয়া দেশে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছে শেষে আত্মকৃত বিভােগই যদি তাহার পরিণাম হয়, ভারতের শনিগ্ৰহ যদি এবার লর্ড কার্জন -মূর্তি পরিহার করিয়া আত্মীয়মূর্তি ধরিয়াই দেখা দেয়, তবে বাহিরের তাড়নায় অস্থির হইয়া ঘরের মধ্যেও আশ্রয় লইবার স্থান পাইব না । এ দিকে একটা প্ৰকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ উপভোগ করিয়াছি, তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে । এই দুর্বলতার কারণ যতদিন আছে ততদিন আমাদের দেশের কোনো মহৎ আশাকে সম্পূর্ণ সফল করা সম্ভবপর হইবে না ; আমাদের সমস্ত রাষ্ট্ৰীয় কর্তব্যপালনই পদে পদে দুরূহ হইতে থাকিবে । বাহির হইতে এই হিন্দুমুসলমানের প্রভেদকে যদি বিরোধে পরিণত করিবার চেষ্টা করা হয় তবে তাহাতে আমরা ভীত হইব না- আমাদের নিজের ভিতরে যে ভেদবুদ্ধির পাপ আছে তাহাকে নিরস্ত করিতে পারিলেই আমরা পরের কৃত উত্তেজনাকে অতিক্রম করিতে নিশ্চয়ই পারিব । এই উত্তেজনা কালক্রমে আপনিই মরিতে বাধ্য। কারণ, এই আগুনে নিয়ত কয়লা জোগাইবার সাধ্য গবর্মেন্টের নাই । এ আগুনকে প্রশ্রয় দিতে গেলে শীঘ্রই ইহা এমন সীমায় গিয়া পৌঁছিবে যখন দমকলের জন্য ডাক পাড়িতেই হইবে। প্রজার ঘরে আগুন ধরিলে কোনোদিন কোনো দিক হইতে তাহা রাজবাড়িরও অত্যন্ত কাছে গিয়া পেঁৗছবে। যদি এ কথা সত্য হয় যে, হিন্দুদিগকে দমাইয়া দিবার জন্য মুসলমানদিগকে অসংগত প্রশ্রয় দিবার চেষ্টা হইতেছে, অন্তত ভাবগতিক দেখিয়া মুসলমানদের মনে যদি সেইরূপ ধারণা দৃঢ় হইতে থাকে, তবে এই শনি, এই কলি, এই ভেদনীতি রাজাকেও ক্ষমা করিবে: না। কারণ, প্রশ্রয়ের দ্বারা আশাকে বাড়াইয়া তুলিলে তাহাকে পূরণ করা কঠিন হয়। যে ক্ষুধা (8s