পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ΑΟ Ο রবীন্দ্র-রচনাবলী স্বাভাবিক তাহাকে একদিন মেটানো যায়, যোগ্যতার স্বাভাবিক দাবিরও সীমা আছে, কিন্তু প্রশ্রয়ে দাবির তো অন্ত নাই। তাঁহা ফুটা কলসীতে জল ভরার মতো। আমাদের পুরাণে কলঙ্কভঞ্জনের যে ইতিহাস আছে তাহারই দৃষ্টান্তে গবর্মেন্ট, প্রেয়সীর প্রতি প্রেমবশতই হউক অথবা তাহার বিপরীত পক্ষের প্রতি রাগ করিয়াই হউক, অযোগ্যতার ছিদ্রঘাট ভরিয়া তুলিতে পরিবেন না। অসন্তোষকে চিরকুভূক্ষু করিয়া রাখিবার উপায় প্রশ্ৰয় । এ-সমস্ত শীখের করাতের নীতি, ইহাতে শুধু এক প্রজা কাটে না, ইহা ফিরিবার পথে রাজাকেও আঘাত দেয়। এই ব্যাপারের মধ্যে যেটুকু ভালো তাহাও আমাদিগকে বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে। আমরা গােড়া হইতে ইংরেজের ইস্কুলে বেশি মনােযোগের সঙ্গে পড়া মুখস্থ করিয়াছি বলিয়া গবর্মেন্টের চাকরি ও সম্মানের ভাগ মুসলমান ভ্রাতাদের চেয়ে আমাদের অংশে বেশি পড়িয়াছে সন্দেহ নাই। এইরূপে আমাদের মধ্যে একটা পার্থক্য ঘটিয়াছে। এইটুকু কোনোমতে না মিটিয়া গেলে আমাদের ঠিক মনের মিলন হইবে না, আমাদের মাঝখানে একটা অসূয়ার-অন্তরাল থাকিয়া যাইবে । মুসলমানেরা যদি যথেষ্টপরিমাণে পদমান লাভ করিতে থাকেন তবে অবস্থার অসাম্য-বশত জ্ঞাতিদের মধ্যে যে মনোমালিন্য ঘটে তাহা ঘুচিয়া গিয়া আমাদের মধ্যে সমকক্ষতা স্থাপিত হইবে। যে রাজপ্ৰসাদ এতদিন আমরা ভোগ করিয়া আসিয়াছি আজ প্রচুর পরিমাণে তাহা মুসলমানদের ভাগে পড়ুক, ইহা আমরা যেন সম্পূর্ণ প্রসন্নমনে প্রার্থনা করি। কিন্তু এই প্ৰসাদের যেখানে সীমা সেখানে পৌঁছিয়া তাহারা যেদিন দেখিবেন বাহিরের ক্ষুদ্র দানে অন্তরের গভীর দৈন্য কিছুতেই ভরিয়া উঠে না, যখন বুঝিবেন শক্তিলাভ ব্যতীত লাভ নাই এবং ঐক্য ব্যতীত সে লাভ অসম্ভব, যখন জানিবেন যে এক দেশে আমরা জস্মিয়াছি সেই দেশের ঐক্যকে খণ্ডিত করিতে থাকিলে ধর্মহানি হয় এবং ধর্মহানি হইলে কখনোই স্বার্থরক্ষা হইতে পারে না, তখনই আমরা উভয় ভ্ৰাতায় একই সমচেষ্টার মিলনক্ষেত্রে আসিয়া হাত ধরিয়া দাড়াইব । যাহা হউক, হিন্দু ও মুসলমান, ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান ভাগকে এক রাষ্ট্ৰসম্মিলনের মধ্যে বাধিবার জন্য যে ত্যাগ, যে সহিষ্ণুতা, যে সতর্কতা ও আত্মদমন আবশ্যক তাহা আমাদিগকে অবলম্বন করিতে হইবে। এই প্ৰকাণ্ড কর্মঋণই যখন আমাদের পক্ষে যথেষ্ট তখন, দোহাই সুবুদ্ধির, দোহাই ধর্মের, প্ৰাণধর্মের নিয়মে দেশে যে নূতন নূতন দল উঠিবে তাহারা প্রত্যেকেই এক-একটি বিরোধরাপে উঠিয়া যেন দেশকে বহু ভাগে বিদীর্ণ করিতে না থাকে ; তাহারা যেন একই তরুকাণ্ডের উপর নব নব সতেজ শাখার মতো উঠিয়া দেশের রাষ্ট্ৰীয় চিত্তকে পরিণতিদান করিতে থাকে । পুরাতন দলের ভিতর দিয়া যখন একটা নূতন দলের উদ্ভব হয় তখন তাহাকে প্রথমটা অনাহূত বলিয়া ভ্ৰম হয়। কার্যকারণ পরম্পরার মধ্যে তাহার যে একটা অনিবাৰ্য স্থান আছে, অপরিচয়ের বিরক্তিতে তাহা আমরা হঠাৎ বুঝিতে পারি না। এই কারণে নিজের স্বত্বপ্রমাণের চেষ্টায় নূতন দলের প্ৰথম অবস্থায় স্বাভাবিকতার শান্তি থাকে না, সেই অবস্থায় আত্মীয় হইলেও তাহাকে বিরুদ্ধ মনে হয় | কিন্তু এ কথা নিশ্চিত সত্য যে, দেশে নূতন দল, বীজ বিদীর্ণ করিয়া অঙ্কুরের মতো, বাধা ভেদ করিয়া স্বভাবের নিয়মেই দেখা দেয়। পুরাতনের সঙ্গেই এবং চতুদিকের সঙ্গে তাহার অন্তরের সম্বন্ধ আছে। এই তো আমাদের নূতন দল ; এ তো আমাদের আপনার লোক । ইহাদিগকে লইয়া কখনো ঝগড়াও করিব, আবার পরীক্ষণেই সুখেদুঃখে ক্রিয়াকর্মে ইহাদিগকেই কাছে টানিয়া একসঙ্গে। কঁাধ মিলাইয়া কাজের ক্ষেত্রে পাশাপাশি দাড়াইতে হইবে । কিন্তু ভ্রাতৃগণ, একট্রিক্টমিস্ট বা চরমপন্থী বা বাড়াবাড়ির দল বলিয়া দেশে একটি দল উঠিয়াছে, এইরূপ যে একটা রটনা শুনা যায়, সে দলটা কোথায় । জিজ্ঞাসা করি, এ দেশে সকলের চেয়ে বড়ো এবং মূল একট্ৰিমিস্ট কে । চরমপস্থিত্বের ধর্মই এই যে, এক দিক চরমে উঠিলে অন্য দিক সেইটানেই আপনি চরমে চড়িয়া যায়। বঙ্গবিভাগের জন্য সমস্ত বাংলাদেশ যেমন বেদনা অনুভব করিয়াছে এবং যেমন দারুণ দুঃখভোগের দ্বারা তাহা প্রকাশ করিয়াছে ভারতবর্ষে এমন বোধ হয়। আর কখনো হয় নাই। কিন্তু প্রজাদের সেই সত্য-বেদনায় রাজপুরুষ যে কেবল উদাসীন তাহা নহে, তিনি ক্রুদ্ধ,