পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ Գ Օ Ֆ খড়গহস্ত । তাহার পরে ভারতশাসনের বর্তমান, ভাগ্যবিধাতা, র্যাহার অভ্যুদয়ের সংবাদমাত্রেই ভারতবর্ষের চিত্তচকোর তাহার সমস্ত তৃষিতচষ্ণু ব্যাদান করিয়া একেবারে আকাশে উড়িয়ছিল, তিনি তাহার সুদূর স্বৰ্গলোক হইতে সংবাদ পাঠাইলেন- যাহা হইয়া গিয়াছে তাহা একেবারেই চূড়ান্ত, তাঙ্গার আর অন্যথা হইতে পারে না । , এতই বধিরভাবে সমস্ত বাংলাদেশের চিত্তবেদনাকে একেবারে চূড়ান্ত করিয়া দেওয়া, ইহাই কি রাজ্যশাসনের চরম পন্থা নহে। ইহার কি একটা প্ৰতিঘাত নাই। এবং সে প্ৰতিঘাত কি নিতান্ত নিজীবিভাবে হইতে পারে । এই স্বাভাবিক প্রতিঘাত শান্ত করিবার জন্য কর্তৃপক্ষ তো কোনো শান্তনীতি অবলম্বন করিলেন না, তিনি চরমের দিকেই চড়িতে লাগিলেন। আঘাত করিয়া যে ঢেউ তুলিয়াছিলেন সেই ঢেউকে নিরস্ত করিবার জন্য উধৰ্বশ্বাসে কেবলই দণ্ডের উপর দণ্ড চালনা করিতে লাগিলেন । তাহাতে তাহারা যে বলিষ্ঠ এ প্রমাণ হইতে পারে, কিন্তু স্বভাব তো এই প্রবল রাজাদের প্রজা নহে। আমরা দুর্বল হই। আর অক্ষম হই, বিধাতা আমাদের যে একটা হৃৎপিণ্ড গড়িয়ছিলেন সেটা তো নিতান্তই একটা মৃৎপিণ্ড নহে- আমরাও সহসা আঘাত পাইলে চিকিত হইয়া উঠি । সেটা একটা স্বাভাবিক প্রতিবৃত্তিক্রিয়া, যাহাকে ইংরেজিতে বলে রিফ্লেক্স অ্যাকশন। এটাকে রাজসভায় যদি অবিনয় বলিয়া জ্ঞান করেন তবে আঘাতটা সম্বন্ধেও বিবেচনা করিতে হয়। যাহার শক্তি আছে সে অনায়াসেই দুইয়ের পশ্চাতে আরো-একটা দুই যোগ করিতে পারে, কিন্তু তাহার পরে ফলের ঘরে চার দেখিলেই উন্মত্ত হইয়া উঠা বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ । স্বভাবের নিয়ম যখন কাজ করে তখন কিছু অসুবিধা ঘটিলেও সেটাকে দেখিয়া বিমর্ষ হইতে পারি না। বিদ্যুতের বেগ লাগাইলে যদি দেখি দুর্বল স্নায়ুতেও প্রবলভাবে সাড়া পাওয়া যাইতেছে তবে বড়ো কষ্টের মধ্যে সেটা আশার কথা । অতএব এ দিকে যখন লর্ড কার্জন, মর্লি, ইবেটুসন ; গুর্থ, পানিটিভ পুলিস ও পুলিস-রাজকতা নির্বাসন, জেল ও বেত্ৰিদণ্ড ; দলন, দমন ও আইনের আত্মবিস্মৃতি ; তখন অপর পক্ষে প্রজাদের মধ্যেও যে ক্রমশই উত্তেজনাবৃদ্ধি হইতেছে, যে উত্তাপটুকু অল্পকাল পূর্বে কেবলমাত্র তাহাদের রসনার প্ৰান্তভাগে দেখা দিয়াছিল তাহা যে ক্রমশই ব্যাপ্ত ও গভীর হইয়া তাহদের অস্থিমজ্জার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতেছে, তাহারা যে বিভীষিকার সম্মুখে অভিভূত না হইয়া অসহিষ্ণু হইয়া উঠিতেছে, ইহাতে আমাদের যথেষ্ট অসুবিধা ও আশঙ্কা আছে তাহা মানিতেই হইবে, কিন্তু সেইসঙ্গে এইটুকু আশার কথা না মনে করিয়া থাকিতে পারি না যে, বহুকালের অবসাদের পরেও স্বভাব বলিয়া একটা পদার্থ এখনো । আমাদের মধ্যে রহিয়া গেছে- প্রবলভাবে কষ্ট পাইবার ক্ষমতা এখনো আমাদের যায় নাই- এবং জীবনধর্মে যে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ার নিয়ম বর্তমান এখনো আমাদের মধ্যে তাহা কাজ করিতেছে । চরমনীতি বলিতেই বুঝায় হালছাড়া নীতি, সুতরাং ইহার গতিটা যে কখন কাহাকে কোথায় লইয়া গিয়া উত্তীর্ণ করিয়া দিবে তাহা পূর্ব হইতে কেহ নিশ্চিতরূপে বলিতে পারে না । ইহার বেগকে সর্বত্র নিয়মিত করিয়া চলা এই পন্থর পথিকদের পক্ষে একেবারেই অসাধ্য। তাহাকে প্রবর্তন করা সহজ, ' সংবরণ করাই কঠিন। এই কারণেই আমাদের কর্তৃপক্ষ যখন চরমনীতিতে দম লাগাইলেন তখন তাহারা যে এতদূর পর্যন্ত পৌঁছিবেন তাহা মনেও করেন নাই। আজ ভারতশাসনকার্যে পুলিসের সামান্য পাহারাওয়ালা হইতে ন্যায়দণ্ডধারী বিচারক পর্যন্ত সকলেরই মধ্যে স্থানে স্থানে যে অসংযম ফুটিয়া বাহির হইতেছে, নিশ্চয়ই তাহা ভারতশাসনের কর্ণধারগণের অভিপ্রেত নহে। কিন্তু গবর্মেন্ট তো একটা অলৌকিক ব্যাপার নহে, । শাসনকাৰ্য যাহাদিগকে দিয়া চলে তাহারা তো রক্তমাংসের মানুষ, এবং ক্ষমতামত্ততাও সেই , মানুষগুলির প্রকৃতিতে অল্পাধিক পরিমাণে প্রবেশ করিয়াছে। যে সময়ে প্রবীণ সারথির প্রবল রাশ ইহাদের সকলকে শক্ত করিয়া টানিয়া রাখে তখনাে যদিচ ইহাদের উচ্চ গ্ৰীবা যথেষ্ট বক্র হইয়া থাকে তথাপি সেটা রাজবাহনের পক্ষে অশোভন হয় না ; কিন্তু তখন ইহারা মোটের উপরে সকলেই এক