পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

AO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী অবলম্বন করিল, ভদ্রঘরের ছেলে নিজের মাথায় কাপড়ের মোট তুলিয়া দ্বারে দ্বারে বিক্রয় করিতে লাগিল এবং ব্ৰাহ্মণের ছেলে নিজের হাতে লাঙল বহা গীেরবের কাজ বলিয়া স্পর্ধা প্রকাশ করিল। আমাদের সমাজে ইহা যে সম্ভবপর হইতে পারে আমরা স্বপ্নেও মনে করি নাই। তর্কের দ্বারা তাক মেটে না ; উপদেশের দ্বারা সংস্কার ঘোচে না ; সত্য যখন ঘরের একটি কোণে একটু শিখার মতো দেখা দেন তখনই ঘর-ভরা অন্ধকার আপনি কাটিয়া যায় । পূর্বে দেশের বড়ো প্রয়োজনের সময়েও দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা চাহিয়া অর্থের অপেক্ষা ব্যর্থতাই বেশি করিয়া পাইতাম কিন্তু সম্প্রতি একদিন যেমনি একটা ডাক পড়িল অমনি দেশের লোক কোনো অত্যাবশ্যক প্রয়োজনের কথা চিন্তা না করিয়া কেবলমাত্র নির্বিচারে ত্যাগ করিবার জন্যই নিজে ছুটিয়া গিয়া দান করিয়া নিজেকে কৃতাৰ্থ জ্ঞান করিয়াছে। তাহার পরে জাতীয় বিদ্যালয় যে কোনোদিন দেশের মধ্যে স্থাপন করিতে পারিব সে কেবল দুটি-একটি অত্যুৎসাহিকের ধ্যানের মধ্যেই ছিল। কিন্তু দেশে শক্তির অনুভূতি একটুও সত্য হইবামােত্রই সেই দুর্লভ ধ্যানের সামগ্ৰী দেখিতে দেখিতে আকার পরিগ্রহ করিয়া দেশকে বরদান করিবার জন্য উদ্যত দক্ষিণহস্তে আজ আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইয়াছেন। একত্রে মিলিয়া বড়ো কারখানা স্থাপন করিব, বাঙালির এমন না ছিল শিক্ষা, না ছিল অভিজ্ঞতা, না। ছিল অভিরুচি। তাহা সত্ত্বেও বাঙালি একটা বড়ো মিল খুলিয়াছে, তাহা ভালো করিয়াই চালাইতেছে, এবং আরো এইরূপ অনেকগুলি ছোটাে বড়ো উদযোগে প্রবৃত্ত হইয়াছে। দেশের ইচ্ছা একটিমাত্র উপলক্ষে যেই আপনাকে সফল করিয়াছে, যেই আপনার শক্তিকে দুঃখ ও ক্ষতির উপরেও জয়ী করিয়া দেখাইয়াছে, অমনি তাহা নানা ধারায় জাতীয় জীবনযাত্রার সমস্ত বিচিত্র ব্যাপারেই যে নিজেকে উপলব্ধি করিবার জন্য সহজে ধাবিত হইবে ইহা অনিবাৰ্য । কিন্তু যেমন এক দিকে সহসা দেশের এই শক্তির উপলব্ধি আমাদের কাছে সত্য হইল তেমনি সেই কারণেই আমরা নিজেদের মধ্যে একটা প্ৰকাণ্ড অভাব অনুভব করিলাম। দেখিলাম, এতবড়ো শক্তিকে বাধিয়া তুলিবার কোনো ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে নাই। স্টীম নানা দিকে নষ্ট হইয়া যাইতেছে, তাহাকে এইবেলা আবদ্ধ করিয়া যথার্থপথে খাটাইবার উপায় করিতে পারিলে তাহা আমাদের চিরকালের সম্বল হইয়া উঠিত- এই ব্যাকুলতায় আমরা কষ্ট পাইতেছি। ভিতরে একটা গভীর অভাব বা পীড়া থাকিলে যখন তাহাকে ভালাে করিয়া ধরিতে বা তাহার ভালোরূপ প্ৰতিকার করিতে না পারি। তখন তাহা নানা অকারণ বিরক্তির আকার ধারণা করিতে থাকে । শিশু অনেক সময় বিনা হেতুতেই রাগ করিয়া তাহার মাকে মারে ; তখন বুঝিতে হইবে, সে রাগ বাহ্যত তাহার মাতার প্রতি কিন্তু বস্তুত তাহা শিশুর একটা-কোনো অনিৰ্দেশ্য অস্বাস্থ্য। সুস্থ শিশু যখন আনন্দে থাকে তখন বিরক্তির কারণ ঘটিলেও সেটাকে সে অনায়াসে ভুলিয়া যায়। সেইরূপ দেশের আন্তরিক যে আক্ষেপ আমাদিগকে আত্মকলহে লইয়া যাইতেছে তাহা আর কিছুই নহে, তাহা ব্যবস্থাবন্ধনের-অভাব-জনিত ব্যর্থ উদ্যমের অসন্তোষ। শক্তিকে অনুভব করিতেছি। অথচ তাহাকে সম্পূর্ণ খাটাইতে পারিতেছি না বলিয়াই সেই অস্বাস্থ্যে ও আত্মগ্লানিতে আমরা আত্মীয়াদিগকেও সহ্য করিতে পারিতেছি না । ] যখন একদিনের চেষ্টাতেই আমরা দেখিয়াছি যে জাতীয় ভাণ্ডারে টাকা আসিয়া পড়া এই | বহুপরিবারভারগ্রস্ত দরিদ্র দেশেও দুঃসাধ্য নহে। তখন এই আক্ষেপ কেমন করিয়া ভুলিব যে, { কেবলমাত্র ব্যবস্থা করিতে না পারাতেই এই একদিনের উদযোগকে আমরা চিরদিনের ব্যাপার করিয়া । তুলিতে পারিলাম না। এমন-কি, যে টাকা আমাদের হাতে আসিয়া জমিয়াছে তাহা লইয়া কী যে করিব তাহাই আজ পর্যন্ত ঠিক করা আমাদের পক্ষে অসাধ্য হইয়া উঠিয়াছে। সুতরাং এই জমা টাকা । মাতৃস্তনের নিরুদ্ধ দুগ্ধের মতো আমাদের পক্ষে একটা বিষম বেদনার বিষয় হইয়া রহিল। দেশের । লোক যখন ব্যাকুল হইয়া বলিতেছে- আমরা দিতে চাই, আমরা কাজ করিতে চাই- কোথায় দিব, । কী করিব তাহার একটা কিনারা হইয়া উঠিলে বীচিয়া যাই-তখনাে যদি দেশের এই উদ্যত ইচ্ছাকে ।