পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সমূহ Գo ( সার্থক করিবার জন্য কোনো-একটা যজ্ঞক্ষেত্র নির্মিত না হয়, তখনো যদি সমস্ত কাজ বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঝগড়া করিয়া আপনার কর্মস্রষ্ট উদ্যম ক্ষয় করে । , তখন ঝগড়ার উপলক্ষও তেমনি অসংগত হয় । আমাদের মধ্যে কেহ বা বলি, আমি ব্রিটিশসাম্রাজ্যভুক্ত স্বায়ত্তশাসন চাহি ; কেহ বা বলি, আমি সাম্রাজ্যনিরপেক্ষ স্বাতন্ত্র্যই চাহি । অথচ এ-সমস্ত কেবল মুখের কথা এবং এতই দূরের কথা যে, ইহার সঙ্গে আমাদের উপস্থিত দায়িত্বের কোনো যোগ নাই । দেবতা যখন কলোনিয়াল সেলফ-গর্বমেন্ট এবং আটনমি এই দুই বর দুই হাতে লইয়া আমাদের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইবেন এবং যখন তাহার মুহুর্তমাত্র বিলম্ব সহিবে না। তখন কোন বরটা তুলিয়া তবে অগত্যা তাহা করিতে হইবে । কিন্তু যখন মাঠে চাষ দেওয়াও হয় নাই তখন কি ফসল ভাগের মামলা তুলিবার বিশেষ প্রয়োজন আছে। ব্যক্তিই বল জাতিই বল, মুক্তিই সকলের চরম সিদ্ধি। কিন্তু শাস্ত্ৰে বলে, নিজের মধ্যেই মুক্তির নিগুঢ় বাধা আছে, সেইগুলা আগে কর্মের দ্বারা ক্ষয় না করিলে কোনোমতেই মুক্তি নাই। আমাদের জাতীয় মুক্তিরও প্রধান বিঘুসকল আমাদের অভ্যন্তরেই নানা আকারে বিদ্যমান। কর্মের দ্বারা সেগুলার যদি ধবংস না হয় তবে তর্কের দ্বারা হইবে না, এবং বিবাদের দ্বারা তাহা বাড়িতেই থাকিবে । অতএব, মুক্তি কয় প্রকারের আছে, সাযুজ্যমুক্তিই ভালো না স্বাতন্ত্র্যমুক্তিই শ্রেয়, শান্তিরক্ষা করিয়া তাহার আলোচনা অনায়াসেই চলিতে পারে। কিন্তু সাযুজ্যই বল আর স্বাতন্ত্র্যই বল, গোড়াকার কথা একই, অর্থাৎ তাহা কর্ম। সেখানে উভয় দলকে একই পথ দিয়া যাত্ৰা করিতে হইবে । যে-সকল প্ৰকৃতিগত কারণে আমরা দরিদ্র ও দুর্বল, আমরা বিভক্ত বিরুদ্ধ ও পরতন্ত্র, সেই কারণ ঘোচাইবার জন্য আমরা যদি সত্যসত্যই মন দিই। তবে আমাদের সকল মতের লোককে একত্রে মিলিতেই হইবে । এই কর্মক্ষেত্রেই যখন আমাদের সকলের একত্রে মিলন নিতান্তই চাই তখন সেই মিলনের জন্য একটি বিশেষ গুণের প্রয়োজন-- তাহা অমত্ততা । আমরা যদি যথার্থ বলিষ্ঠমনা ব্যক্তির ন্যায় কথায় ও ব্যবহারে, চিন্তায় ও প্রকাশে পরিমাণরক্ষা করিয়া না চলিতে পারি। তবে মিলনই আমাদের পক্ষে বিরোধের হেতু হইবে, এবং কর্মের চেষ্টায় লাভ না হইয়া বারংবার ক্ষতি ঘটাইতে থাকিবে । এই বিষয়ে আজকালকার ভারতীয় রাজপুরুষদের সমান চালে চলিবার চেষ্টা করিলে আমাদের অনিষ্টই হইবে । বর্তমান ভারত-শাসন ব্যাপারে একটা উৎকট হিস্টিরিয়ার আক্ষেপ হঠাৎ থাকিয়া থাকিয়া কখনো” পাঞ্জাবে, কখনো মাদ্রাজে, কখনো বাংলায় যেরূপ অসংযমের সহিত প্ৰকাশ পাইয়া উঠিতেছে সেটা কি আমাদের পক্ষে একটা দৃষ্টান্ত । যাহার হাতে বিরাট শক্তি আছে সে যদি অসহিষ্ণু হইয়া চাঞ্চল্য প্রকাশ করাকেই পৌরুষের পরিচয় বলিয়া কল্পনা করে এবং নিজের রচনাকে নিজে বিপর্যন্ত করিয়া সাস্তুনা পায় তবে তাহার সেই চিত্তবিকার আমাদের মতো দুর্বলতর পক্ষকে যেন অনুকরণে উত্তেজিত না করে। বস্তুত, প্ৰবলই হউক আর দুর্বলই হউক, যে ব্যক্তি বাক্যে ও আচরণে অন্তরের ভাবাবেগকে যথেষ্ট পরিমাণে সংযত করিতে না পারিয়াছে সেই ব্যক্তি সকল কর্মের অন্তরায়, এ কথাটা ক্ষোভবশত আমরা যখনই ভুলি ইহার সত্যতাও তখনই সবেগে সপ্ৰমাণ হইয়া উঠে । সম্প্রতি দেশের কর্ম বলিতে কী বুঝায় এবং তাহার যথার্থ গতিটা কোন দিকে সে সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে যে সত্যকার কোনো মতভেদ আছে। এ কথা আমি মনে করিতেই পারি না । কর্মের প্রয়োজন । কর্মের উপযুক্ত সুযোগ পাইলেই এই শক্তি নানা আশ্চর্য ও অভাবনীয় রূপে অভিব্যক্ত হইতে থাকে । এমন যদি উপায় থাকিত যাহাতে ফলটা পাওয়া যায়। অথচ শক্তিটার কোনো প্রয়োজনই হয় না। তবে তাহাকে আমরা সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য করতে পারিতাম না । r