পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aobr রবীন্দ্র-রচনাবলী জোতদার ও চাষা রােয়ত যতদিন প্রত্যেকে স্বতন্ত্র থাকিয়া চাষবাস করিবে ততদিন তাঁহাদের অসচ্ছল অবস্থা কিছুতেই ঘুচিবে না। পৃথিবীতে চারি দিকে সকলেই জোট বাধিয়া প্রবল হইয়া উঠিতেছে ; এমন অবস্থায় যাহারাই বিচ্ছিন্ন একক ভাবে থাকিবে তাহাদিগকে চিরদিনই অন্যের গোলামি ও মজুরি করিয়া মরিতেই হইবে । আদ্যকার দিনে যাহার যতটুকু ক্ষমতা আছে সমস্ত একত্র মিলাইয়া বাধ বাধিবার সময় আসিয়াছে। এ না হইলে ঢালু পথ দিয়া আমাদের ছোটাে ছোটাে সামর্থ্য ও সম্বলের ধারা বাহির হইয়া গিয়া অন্যের জলাশয় পূর্ণ করিবে। অন্ন থাকিতেও আমরা অন্ন পাইব না এবং আমরা কী কারণে কেমন করিয়া যে মরিতেছি তাহা জানিতেও পারিব না। আজ যাহাদিগকে বঁাচাইতে চাই তাহাদিগকে মিলাইতে হইবে। যুরোপে আমেরিকায় কৃষির নানাপ্রকার মিতশ্রমিক যন্ত্র বাহির হইয়াছে’- নিতান্ত দারিদ্র্যবশত সে-সমস্ত আমাদের কোনো কাজেই লাগিতেছে না- অল্প জমি ও অল্প শক্তি লইয়া সে-সমস্ত যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব নহে। যদি এক-একটি মণ্ডলী অথবা এক-একটি গ্রামের সকলে সমবেত হইয়া নিজেদের সমস্ত জমি একত্র মিলাইয়া দিয়া কৃষিকার্যে প্রবৃত্ত হয় তবে আধুনিক যন্ত্রাদির সাহায্যে অনেক খরচ বাচিয়া ও কাজের সুবিধা হইয়া তাহারা লাভবান হইতে পারে। যদি গ্রামের উৎপন্ন সমস্ত ইক্ষু তাহারা এক কলে মাড়াই করিয়া লয়। তবে দামি কল কিনিয়া লইলে তাহাদের লাভ বৈ লোকসান হয় না । পাটের খেত সমস্ত এক করিয়া লইলে প্রেসের সাহায্যে তাহারা নিজেরাই পাট বাধাই করিয়া লাইতে পারে। গোয়ালারা একত্র হইয়া জোট করিলে গো-পালন ও মাখন ঘূত প্রভৃতি প্ৰস্তুত করা সস্তায় ও ভালোমতে সম্পন্ন হয় । তঁাতিরা জোট বাধিয়া নিজের পল্লীতে যদি কল আনে এবং প্রত্যেকে ভূল ভূমির খান দেয়। তবে কাপড় বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হওয়াতে তাহদের প্রত্যেকেরই ধা ঘটে । শহরে ধনী মহাজনের কারখানায় মজুরি করিতে গেলে শ্রমীদিগের মনুষ্যত্ব কিরূপ নষ্ট হয় সকলেই জানেন । বিশেষত আমাদের যে দেশের সমাজ গৃহের উপরে প্রতিষ্ঠিত সেখানে গৃহিনীতি বিচলিত হইলে ধর্মের প্রধান অবলম্বন জীর্ণ হইয়া পড়ে ও সমাজের মর্মস্থানে বিষসঞ্চার হইতে থাকে। সে দেশে বড়ো বড়ো কারখানা যদি শহরের মধ্যে আবর্ত রচনা করিয়া চারি দিকের গ্রামপল্পী হইতে দরিদ্র স্ত্রীপুরুষগণ নিরানন্দকার কলের কাজে ক্রমশই কিরূপ দুৰ্গতির মধ্যে নিমজ্জিত হইতে পারে তাহা অনুমান করা কঠিন নহে। কলের দ্বারা কেবল জিনিসপত্রের উপচয় করিতে গিয়া মানুষের অপচয় করিয়া বসিলে সমাজের অধিকদিন তাহা সহিবে না। অতএব পল্লীবাসীরাই একত্রে মিলিলে যে-সকল যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভবপর হয় তাহারই সাহায্যে স্বস্থানেই কর্মের উন্নতি করিতে পারিলে সকল দিক রক্ষা হইতে পারে । শুধু তাই নয়, দেশের জনসাধারণকে ঐক্যনীতিতে দীক্ষিত করিবার এই একটি উপায় । প্রাদেশিক সভা উপদেশ ও দৃষ্টান্ত দ্বারা একটি মণ্ডলীকেও যদি এইরূপে গড়িয়া তুলিতে পারেন তবে এই দৃষ্টান্তের সফলতা দেখিতে দেখিতে চারি দিকে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িবে। এমনি করিয়া ভারতবর্ষের প্রদেশগুলি আত্মনির্ভরশীল ও বৃহবদ্ধ হইয়া উঠিলে ভারতবর্ষের দেশগুলির মধ্যে তাহার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা সার্থক হইয়া উঠিবে এবং সেই দৈশিক কেন্দ্রগুলি একটি মহাদেশিক কেন্দ্রচূড়ায় পরিণত হইবে। তখন সেই কেন্দ্রটি ভারতবর্ষের সত্যকার কেন্দ্ৰ হইবে। নতুবা পরিধি যাহার প্রস্তুতই হয় নাই সেই কেন্দ্রের প্রামাণিকতা কোথায় । এবং যাহার মধ্যে দেশের কর্মের কোনো উদযোগ নাই, কেবলমাত্র দুর্বল জাতির দাবি এবং দায়িত্বহীন পরামর্শ, সে সভা দেশের রাজকর্মসভার সহযোগী হইবার আশা করিবে কোন সত্যের এবং কোন শক্তির বলে। কল আসিয়া যেমন তঁাতকে মারিয়াছে তেমনি ব্রিটিশ শাসনও সর্বগ্রহ ও সর্বব্যাপী হইয়া আমাদের গ্ৰাম্যসমাজের সহজ ব্যবস্থাকে নষ্ট করিয়া দিয়াছে। কালক্রমে প্রয়োজনের বিস্তার-বশত ছোটো ব্যবস্থা যখন বড়ো ব্যবস্থায় পরিণত হয় তখন তাহাতে ভালো বৈ মন্দ হয় না- কিন্তু তাহা স্বাভাবিক পরিণতি হওয়া চাই। আমাদের যে গ্ৰাম্যব্যবস্থা ছিল, ছোটাে হইলেও তাহা আমাদেরই ছিল। ব্রিটিশ ব্যবস্থা যত