পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ Տեր g রবীন্দ্র-রচনাবলী র্যাহার সন্তান। তখন মুসলমানই কি আর নমশ্বত্রই কি, বেহারি উড়িয়া অথবা অন্য যে-কোনো ইংরাজিশিক্ষায়-পশ্চাদবর্তী জাতিই কি, নিজের শ্রেষ্ঠতার অভিমান লইয়া কাহাকেও ব্যবহারে বা বাকো বা চিন্তায় অপমানিত করিব না । তখনই সকল মানুষের সেবা ও সম্মানের দ্বারা যিনি সকল প্ৰজার প্ৰজাপতি তাহার প্রসন্নতা এই ভাগ্যহীন দেশের প্রতি আকর্ষণ করিতে পারিব | নতুবা আমার রাগ হইয়াছে বলিয়াই দেশের সকল লোককে আমি রাগাইয়া তুলিব, অথবা আমি ইচ্ছা করিতেছি বলিয়া দেশের সকল লোকের ইচ্ছাকে আমার অনুগত করিব, ইহা কোনো বাগিতার দ্বারা কদাচ ঘটিবে না । ক্ষণকালের জন্য একটা উৎসাহের উত্তাপ জাগাইয়া তুলিতে পারি, কিন্তু তাহা সত্যকার ইন্ধনের অভাবে কখনোই স্থায়ী হইতে পরিবে না । সেই সত্যপদার্থ মানুষ- সেই সত্যপদার্থ মানুষের হৃদয়বুদ্ধি, মানুষের মনুষ্যত্ব ; স্বদেশী মিলের কাপড় অথবা করকচ লবণ নহে। সেই মানুষকে প্রত্যহ অপমানিত করিয়া মিলের কাপড়ের পূজা করিতে থাকিলে আমরা দেবতার বর পাইব না। বরঞ্চ উলটা ফলই পাইতে থাকিব । একটি কথা আমরা কখনো ভুলিলে চলিবে না যে, অন্যায়ের দ্বারা, অবৈধ উপায়ের দ্বারা কার্যোদ্ধারের নীতি অবলম্বন করিলে কাজ আমরা অল্পই পাই, অথচ তাহাতে করিয়া সমস্ত দেশের বিচারবুদ্ধি বিকৃত হইয়া যায়। তখন কে কাহাকে কিসের দোহাই দিয়া কোন সীমার মধ্যে সংযত করবে। দেশহিতের নাম করিয়া যদি মিথ্যাকেও পবিত্র করিয়া লই এবং অন্যায়কেও ন্যায়ের আসনে বসাই। তবে কাহাকে কোনখানে ঠেকাইব । শিশুও যদি দেশের হিতাহিত সম্বন্ধে বিচারক হইয়া উঠে এবং উন্মত্তও যদি দেশের উন্নতিসাধনের ভার গ্রহণ করে তবে সেই উচ্ছঙ্খলতা সংক্রামক হইতে থাকিবে, মহামারীর ব্যাপ্তির মতো তাহাকে রোধ করা কঠিন হইবে। তখন দেশহিতৈষীর ভয়ংকর হস্ত হইতে দেশকে রক্ষা করাই আমাদের পক্ষে সকলের চেয়ে দুঃখকর সমস্যা হইয়া পড়িবে। দুবুদ্ধি স্বভাবতই কোনো বন্ধন স্বীকার করে না ; বৃহৎভাবে সকলের সহিত যুক্ত হইয়া বৃহৎ কাজ করিতে সে সহজেই অক্ষম । দুঃস্বপ্ন যেমন দেখিতে দেখিতে অসংগত অসংলগ্ন -ভাবে এক বিভীষিকা হইতে আর-এক বিভীষিকায় লাফ দিয়া চলিতে থাকে তেমনি মঙ্গলবুদ্ধির অরাজকতার দিনে নিতান্তই সামান্য কারণে চন্দননগরের মেয়রকে হত্যা করিবার আয়োজন হয়, কোথাও কিছু নাই হঠাৎ কুষ্ঠিয়ার নিতান্ত নিরপরাধ পাদ্রির পৃষ্ঠে গুলি বর্ষিত হয়, কেন-যে ট্রামগাড়ির প্রতি সাংঘাতিক আক্রমণের উদযোগ হয় তাহা কিছুই বুঝিতে পারা যায় না ; বিভীষিকা অত্যন্ত তুচ্ছ উপলক্ষ অবলম্বন করিয়া চারি দিকে ছড়াইয়া পড়িতে থাকে এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন মত্ততা মাতৃভূমির হৃৎপিণ্ডকেই বিদীর্ণ করিয়া দেয় ।” এইরূপ ধর্মহীন ব্যাপারে প্রণালীর ঐক্য থাকে না, প্রয়োজনের গুরুলঘুতা-বিচার চলিয়া যায়, উদ্দেশ্য ও উপায়ের মধ্যে সুসংগতি স্থান পায় না, একটা উদভ্ৰান্ত দুঃসাহসিকতাই লোকের কল্পনাকে উত্তেজিত করিয়া তুলে। অদ্য বার বার দেশকে স্মরণ করাইয়া দিতে হইবে যে, অধ্যবসায়ই শক্তি এবং অধৈৰ্যই দুর্বলতা ; প্রশস্ত ধর্মের পথে চলাই নিজের শক্তির প্রতি সম্মান ; এবং উৎপাতের সংকীর্ণ পথ সন্ধান করাই কাপুরুষতা, তাহাই মানবের প্রকৃত শক্তির প্রতি অশ্রদ্ধা, মানবের মনুষ্যধর্মের প্রতি অবিশ্বাস । অসংযম নিজেকে প্ৰবল বলিয়া অহংকার করে । কিন্তু তাহার প্রবলতা কিসে । সে কেবল আমাদের যথার্থ অন্তরতর বলের সম্বলকে অপহরণ করিবার বেলায়। এই বিকৃতিকে যে-কোনো উদ্দেশ্যসাধনের জন্যই একবার প্রশ্রয় দিলে শয়তানের কাছে মাথা বিকাইয়া রাখা হয়। প্রেমের কাজে, সৃজনের কাজে, পালনের কাজেই যথার্থভাবে আমাদের সমস্ত শক্তির বিকাশ ঘটে । কোনো-একটা দিকে আমরা মঙ্গলের পথ নিজের শক্তিতে একটুমাত্ৰ কাটিয়া দিলেই তাহা অভাবনীয়রূপে শাখায় প্রশাখায় ব্যাপ্ত ১ কঁকিনাড়ার কারখানার ইংরেজ কর্মচারীদের প্রতি লক্ষ করিয়া রেলগাড়িতে বােমা ষ্টুড়িবার পূর্বে এই প্ৰবন্ধ লিখিত হয়। কোনো ছিদ্রে পাপ একবার অন্তরে প্রবেশ করিতে পারিলে ক্রমশই মানুষকে তাহা কিরূপে বিকৃতিতে লইয়া যায়, এই লজ্জাকর শোচনীয় ঘটনাই তাহার প্রমাণ ।