পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট 8S পুরস্কার কারণ এই যে, ইংরাজ আমলে ভারতশাসনের উচ্চতর অধিকার সকল হইতে আমরা 3िएछ | আমাদিগকে যেটুকু অধিকার দেওয়া হইয়াছে তাহা যদি সহ্য না হয়, যদি সেটা ফিরাইয়া লইবার মতলব থাকে, তবে লও- কিন্তু গালিমন্দ কেন । ঈসপের কথামালায় নেকড়ে বাঘ যখন মেষশাবকটিকে ভক্ষণ করিতে ইচ্ছা করে তখন বলে, তুমি আমার ঝর্নার জল নষ্ট করিয়াছ। মেষ বলে, প্ৰভু, তুমি উপরের জল খাও, আমি নীচের জল খাইতেছি, তোমার জল আমি নষ্ট করিলাম কেমন করিয়া । বাঘ বলে, তুই না করিস তোর বাপ করিয়াছিল ; তাহার পর এক চপেটাঘাত । আমরা মেষশাবকেরও অধম ৷ প্ৰভেদ এই যে, বাঘের পক্ষে যেটা ছুতা ছিল ম্যাকেঞ্জি-সাহেবের পক্ষে সেইটেই আসল কথা। এতদিন সেটা চাপিয়া গিয়াছিলেন ; খানার পরে পরিতৃপ্তমনে বন্ধুসভায় সেটা ব্যক্ত করিয়াছেন। ঐশ্বৰ্য-ঝর্নায় ম্যাকেঞ্জি-সাহেবদের অনেক নীচের জলে আমরা তৃষ্ণা নিবারণ করিয়া থাকি । কিন্তু সেও অসহ্য । ম্যাকেঞ্জি-সাহেব তাহার ভোজ্যবসানের বক্তৃতায় বলিয়াছেন, কলিকাতার কর্তৃত্বভার অসাবধানে আমাদের হাত হইতে অনেকটা খসিয়া পড়িয়াছে। হায় ! এটুকুর প্রতিও লোভ ! যাহা স্বহস্তে দান করিয়াছ তাহার প্রতিও লোলুপ দৃষ্টি ! বিস্তর নীচে আছি, এবং অত্যন্ত অল্প জল পাই ; আমাদের দেশী স্পর্শে তোমাদের উচ্চ শিখরের জল তো আমরা ঘোলা করি নাই । নেকড়ে বাঘ মনে মনে বলেন, উচ্চ হােক নীচ হােক, প্ৰভুত্বের স্বাদমাত্ৰই তোমাদিগকে দিতে চাহি না। তাহার পর মুখে বলেন, “তোমরা অযোগ্য, ইন্ডিয়া-ক্লাবে বৈঠক কর, তোমরা স্বদেশের প্রতিনিধি N3 ' বেসরকারি ইংরাজ-সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বাগযুদ্ধ চলে। আমরা অনেক সময় রাগের মুখে পরস্পরের প্রতি করুণবাক্য প্রয়োগ করি না । কিন্তু র্যাহারা ভারতশাসনকার্যে রাজস্থানীয় এতদিন তাহারা প্ৰজাসাধারণকে প্রকাশ্যে রূঢ়ভাষায় অপমান করেন নাই । আমাদের প্রতি তাহাদের যে অত্যন্ত শ্রদ্ধা আছে তাহা না হইতে পারে, প্রচুর স্নেহ আছে এমন অভিমােনও হয়তো না করিতে পারি, কিন্তু তাহারা বাকসংযম করিয়া গেছেন। তাহার একটা কারণ, র্তাহারা যে উচ্চ পদের উন্নত শিখরে থাকেন সেখান হইতে একটি ছােটাে কথা বর্ষণ করিলেও নীচের । লোকের মাথার পক্ষে তাহা গুরুতর হইয়া উঠে- এরূপ অসমকক্ষ আক্রমণ বীরোচিত নহে। ইংরাজি ভাষায় যাহাকে cowardliness অর্থাৎ কাপুরুষতা বলে ইহাও তাঁহাই। আর-একটা কারণ এই যে, কথার কলহ তাহার পক্ষে অনাবশ্যক এবং অযোগ্য ; কারণ, তাহার হাতে ক্ষমতা আছে । শক্তস্য ভূষণং ক্ষমা। সে ক্ষমা কাজের ক্ষমা না হইলেও, অন্তত বাক্যের ক্ষমা হওয়া উচিত । রাজনীতির হিসাবেও বাকসংযমের সার্থকতা আছে। রাজকাৰ্য সকল সময়ে প্রজার অনুকূলে যায় না। অতএব মাঝে মাঝে যখন কঠিন আইন বা অপ্রিয় করবৃদ্ধি প্রজার উপরে জারি করিতে হইবে তখন দুর্বাক্য-দ্বারা সেটাকে আরো তিক্ত করিয়া তুলিলে রাজাপ্রজার মধ্যে একটা সংঘর্ষ অনাহুত বাড়াইয়া তোলা হয় । স্বাধীন ইংলন্ডে পার্লামেন্টে ভিন্ন ভিন্ন দলের মধ্যে বিবাদ-বচসা হইয়া থাকে, কেহ কহাকেও ছাড়িয়া কথা কহে না । কিন্তু সেখানে জনসাধারণে যাহা চায় রাজশক্তি তাহার বিরুদ্ধে যায় না। এইজন্য দেশ যে কী চায় তাহা নানা দলের আন্দোলনে সম্পূর্ণ আলোচিত হইয়া স্পষ্ট আকার ধারণ করে। এ দেশে আমরা যাহা প্রার্থনীয় জ্ঞান করি না তাহাও রাজা আমাদিগকে গিলিতে বাধ্য করেনআমাদের মতামত ইচ্ছানিচ্ছার দ্বারা রাজশাসন নিয়মিত হয় না। এখানে সম্পূর্ণই কর্তার ইচ্ছা কর্মসে স্থলে গায়ে পড়িয়া প্রজাসাধারণ বা সম্প্রদায়বিশেষকে রূঢ় কথায় ক্ষুব্ধ করিয়া তোলা না সুশোভন, না। রাজনীতিসংগত । তিক্ত বড়িকে মিষ্ট-আকারে গেলানো রাজনীতির নৈপুণ্য। রাজশাসনের পথকে যত সংঘাত-সংঘর্ষ-হীন করিয়া তোলা যায় ততই রাজ্যের পক্ষে এবং শাসনকর্তাদের পক্ষে মঙ্গল। অবশ্য