পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ዓ¢ S আবার রাজা-রায়বাহাদুর-বংশের শাখা-প্ৰশাখা আত্মীয়-কুটুম্ব ভাগিনেয়-ভ্রাতুষ্পপুত্র খুড়তুত-মাসতুত ভাইরা মিলিয়া উক্ত বংশকে বংশমর্যাদার বহুদূর বাহিরে ব্যাপ্ত বিক্ষিপ্ত করিয়া দেয়। বটের উচ্চ শাখা যেমন তাহার নিম্নগামী অসংখ্য ঝোরাকে ঝাড়িয়া ফেলিতে পারে না, যতই অদ্ভুত এবং যতই গুরুতর হউক তাহাদিগকে রাত্রিদিন ঘনিষ্ঠভাবে বহন করিতে থাকে, তেমনি আমাদের দেশে নিম্নগামী দূরতম এবং দীনতম কুটুম্বস্বজনকেও ত্যাগ করিবার জো নাই ; যদি-বা তাহাদিগকে অন্ন হইতে বঞ্চিত করা যায়। তথাপি সর্বপ্রকার ক্রিয়াকর্মে লৌকিকাচারে তাহদের সম্পর্শক্রামকতা হইতে আপন আভিজাত্যকে বঁাচাইয়া চলিবার কোনো উপায় নাই | এইরূপে উচ্চ পদবী বাহিরকে ভিতর হইতে এবং ভিতরকে বুকুত ঠেকাইয়া রাখতে পারে না। সাধারণ এবং অসাধারণের মাঝখানে মায়াগবি কিছুতেই ୩ | আমাদের দেশে কঠিন জাতিভেদ যেমন এক দিকে ভিন্ন বর্ণের মধ্যে অলঙঘ্য সামাজিক ব্যবধান স্থাপন করিয়াছে তেমনি অন্য দিকে ধনী দরিদ্র, উচ্চ নীচ, রাজটিকা-লাঞ্ছিত ও খেতাববঞ্চিতদিগকে সমান করিয়া রাখিয়াছে। প্রাচীন বংশের একটা মোহ আছে বটে। কিন্তু বর্তমান ধনী জমিদারদের মধ্যে নাটাের প্রভৃতি দুই-এক ঘর ছাড়া প্রাচীন বংশ নাই বলিলেই হয়। আমাদের দেশে যেরূপ সম্পত্তিবিভাগ তাহাতে ধনগৌরবকে প্রাচীন করিয়া তোলা একপ্রকার অসাধ্য ; দায়ভাগের শতঘ্নীপ্ৰহারে সে দেখিতে দেখিতে শতধাবিভক্ত হইয়া অকালে পঞ্চােত্ব এমন-কি, পঞ্চাধিকত্ব প্ৰাপ্ত হয় । এই তো গেল। গৌরবের কথা । কিন্তু আমাদের দেশে ধনের গৌরব অদ্যাপি যথেষ্ট জাগে নাই বটে তবু তাহার প্রয়োজন যথেষ্ট আছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না । অতএব যাহাদের হাতে ধন আছে তাহারা প্রয়ােজনসাধন করিয়া সাধারণের আনুগত্য আকর্ষণ করিতে পারেন। তঁহাদের পক্ষে নেতা হইবার সেই একটা সোনার রাস্তা আছে । কিন্তু আমাদের অভিজাতগণ যাহাকে রাজপথ জ্ঞান করেন তাহা রাজা হইবার পথ । অন্য পথের শেষে দেশের কল্যাণ ও সাধারণের হৃদয় থাকিতে পারে। কিন্তু খেতাবের খনি নাই, এইজন্য সে পথে বড়োলোকের জুড়িগাড়ি প্রায় দেখা যায় না। একটা দৃষ্টান্ত দিলেই তাহা সকলের প্রতীত হইবে । সার আলফ্রেড ক্রফটু হয়তো ভালো লোক এবং বড়োলোক, কিন্তু বিদ্যাসাগর তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি ভালো লোক এবং বড়োলোক, এবং সকলের বেশি, তিনি আমাদের স্বদেশী লোক । কিন্তু ধনীগণ উৎসুক হইয়া উঠিয়াছেন ; আর, বিদ্যাসাগর। ইহসংসার ত্যাগ করিয়া গেলেন, দেশের ধনশালীরা কোনোপ্রকার চেষ্টা করিলেন না । ইহারা দেশের ন্যাচারাল লীডার ! আমাদের স্বাভাবিক চালক ! ইহারা কোন দিকে আমাদিগকে চালনা করিবেন ? আমাদের দেশের মহােচ্চ মাহদাশয়দিগের দিকে নহে, ইংরাজ মেজোসাহেব সেজোসাহেব ছোটোসাহেবের দিকে ; আমাদের দীনহীন দেশের সহস্ৰ অভাবমোচনের দিকে নহে, সাহেবের নিকুঞ্জবনে গড়ের বাদ্যের শ্ৰীবৃদ্ধিসাধনের দিকে । সাহেব রাজকর্মচারীরা বিলাতে চলিয়া গেলে দেশীয় ধনীগণ র্তাহাদের প্রতিমা স্থাপন করিবেন ইহাতে আমরা আপত্তি করি না, কিন্তু দেশীয় পূজ্যগণের জন্যও যদি সেই পরিমাণে কিছু ত্যাগান্ধীকার করেন তবে দেশের নায়কত্বে তাহদের কথঞ্চিৎ দাবি থাকে । সেকালের ধনী জমিদারগণ নবাব-সরকারে প্রতিপত্তি ও পদবী -লাভের জন্য কিরাপ চেষ্টা করিতেন ও কোনাে চেষ্টা করিতেন কি না, তাহা আমরা ভালোরূপ জানি না। তখন নবাব-দরবারের প্রসন্নতা হইতে কেবল শূন্যগর্ভ খেতাব ফলিত না, তখন সম্মানের মধ্যে সৌভাগ্য এবং রাজপদের মধ্যে সম্পদ পূর্ণ থাকিত ; অতএব তাহা লাভের জন্য অনেকেই চেষ্টা করিতেন সন্দেহ নাই। কিন্তু তখনকার যাহা সাধারণ হিতকাৰ্য-অর্থাৎ দিঘি-খনন, মন্দির-স্থাপন, বাধা-নির্মাণ, এই সকলকেই তাহারা যথার্থ কীর্তি বলিয়া জ্ঞান করিতেন, খেতাব-লোভকে নহে । দশের নিকট ধন্য হইবার আকাঙক্ষণ তাহদের প্রবল ছিল। তখন এই সকল হিতকার্য রাজসম্মানের মূল্যস্বরূপ ছিল না, ইহাতে সাধারণের সম্মান আকর্ষণ