পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

68 融 রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্রদ্ধার অভাবে স্বদেশের লোকও আমাদের প্রতি বিমুখ হইয়াছে। সেইজন্য আমাদের দেশের অনেক শিক্ষিত লোক এবং বিলাত-ফেরতরা সাধারণ লোকদের হইতে আপনাদিগকে যেন স্বতন্ত্ৰশ্রেণীভুক্ত করিয়া রাখিতে ভালোবাসেন । বাহ্য বেশভূষা আচারব্যবহারেও র্তাহারা আপনাদের পার্থক্য কিছু যেন অস্বাভাবিক আড়ম্বরের সহিত জাহির করিয়া রাখিতে চান । কতকটা পার্থক্য যে আপনিই হইয়া পড়ে সে কথা অস্বীকার করিবার জো নাই। ইংরাজি-শিক্ষিত এবং ইংরাজিতে অশিক্ষিত লোকদের মধ্যে যে কেবল শিক্ষার তারতম্য তাহা নহে, শিক্ষার শ্রেণীভেদ বর্তমান । পরস্পরের বিশ্বাস সংস্কার রুচি এবং চিন্তা করিবার প্রণালী ভিন্ন রকমের হইয়া যায় । এবং ইংরাজি-শিক্ষিত ব্যক্তি আপনাদিগকেই শিক্ষিত ও শ্রেষ্ঠ এবং অপরসাধারণকে অশিক্ষিত এবং পশ্চাদবর্তী না মনে করিয়া থাকিতে পারে না। জ্ঞানস্পাহা ও রসবোধ, বুদ্ধি এবং কল্পনা, সাহস ও বাহুবল, অধ্যবসায় ও আত্মসম্মানে য়ুরোপীয় জাতির যে এক মহােচ্চ আদর্শ ইংরাজি শিক্ষা আমাদের মনে জাজ্বল্যমান করিয়া তুলিতেছে তাহার যদি কোনো আকর্ষণ না থাকিবে তবে আমাদের শিক্ষাকে ধিক ! সেই আকর্ষণ আমাদিগকে অনেক সময় ছদ্মবেশ এবং আত্মপ্রতারণায় লইয়া যায় । কেবল ইংরাজি শিখিয়াই আমরা যেন ইংরাজের মহত্ত্বকে কতকটা আপনার বলিয়া মনে করি, এবং যাহারা ইংরাজি শেখে নাই তাহাদিগকে কতকটা বাহিরের লোকের মতো করিয়া দেখি । ইংরাজের মহত্ত্ব যে ঐতিহাসিক, তাহা যে বংশপরম্পরাগত, কর্মগত, চরিত্রগত- ইংরাজের ভাষা সাহিত্য বিজ্ঞান যে সেই ইতিহাস, সেই চরিত্র হইতে উদ্ভূত হইয়াছে— তাহা যে শুদ্ধমাত্র স্কুলে অধ্যয়ন এবং পরীক্ষা পাস হইতে নহে- ইহা আমরা চোখ বুজিয়া ভুলিতে ইচ্ছা করি। এবং ইংরাজের স্কুলে পড়িয়াছি বলিয়াই আমরা নিজেকে ইংরাজশ্রেণীয় জ্ঞান করি। এইরূপ ইংরাজের টানে দেশ হইতে পৃথক হইয়া যাইবার যে ভােব আমাদের মধ্যে দেখা যাইতেছে তাহা কোনো এক পক্ষের মধ্যে বদ্ধ নহে ; তাহা নানা আকারে নানা দিক হইতে প্ৰকাশ পায় । মুখুজেমশায় এবং বাড়ুজেমশায় কেহই তাহা হইতে পরিত্রাণ পান নাই। আজকাল জমিদারবর্গ ইংরাজের মুখ না তাকাইয়া, উপাধির দিকে লক্ষ না রাখিয়া দেশহিতকর কোনো কাজে প্রবৃত্ত হইতে চান না- দেশের লোকের স্তুতিনিন্দা তীহাদের কাছে এতই ক্ষুদ্র হইয়া গেছে । তেমনি আমাদের দেশে যাহারা জননায়ক বলিয়া সর্বদা সভামঞ্চের উপরে আরোহণ করেন তাহদেরও ভাবগতিক দেখিয়া আমাদের মনে আশ্বাস হয় না । বরঞ্চ আমাদের জমিদারদিগকে দেখিতে শুনিতে ঠিক আমাদের দেশের লোকের মতো, কিন্তু আমাদের জননায়কদের অনেকেই যে দেশের মুরুবি বলিয়া আপনাদিগকে প্রচার করেন সে দেশকে আচারে ব্যবহারে জীবনযাত্রায় অহরহ অপমানিত করেন। ইংরাজরাহুকর্তৃক জমিদারদের যদি অর্ধগ্ৰাস হইয়া থাকে, ইহাদের একেবারে পূৰ্ণগ্ৰাস । জমিদারগণ দেশের জন্য যাহা করেন তাহা গবর্মেন্টের মুখ তাকাইয়া, ইহারা যাহা করেন তাহাও ইংরাজের প্রতি লক্ষ রাখিয়া । তাহার ভাষা ইংরাজি, তাহার প্রণালী ইংরাজি, তাহার প্রচার ইংরাজিতে। ইংরাজ-দৃষ্টির প্রবল আকর্ষণ হইতে ইহারা আপনাদিগকে প্ৰাণ ধরিয়া বিচ্ছিন্ন করিতে *क क्रों । এই স্থলে আমাদের কোনো বন্ধুর লেখা হইতে নিম্নলিখিত সংবাদটি আমরা উদধূত করি।-- ‘স্বগীয় ভূদেব মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের স্বদেশগ্ৰীতির বিষয় অনেকেই অবগত আছেন। দুই-তিন বার কনগ্রেস হইবার পর একজন ভদ্রলোক তঁহাকে কনগ্রেস সম্বন্ধে অভিপ্ৰায় জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন, “ভারতবর্ষ একটা মহাদেশ ; এই মহাদেশের অন্তর্গত প্ৰত্যেক বিভাগের নেতাগণের যত্নে যদি সমস্ত দেশ মিলিত হইতে পারে তাহা হইলে এক মহাজাতির অভ্যুত্থান কল্পনা করিতে পারি বটে, কিন্তু বর্তমান কনগ্রেসওয়ালাদিগের দ্বারা যে তাহা সংসাধিত হইবে না। তাহা নিশ্চয় বলা