পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । AVS ও উপহাস করা আবশ্যক বলিয়া জ্ঞান করে, বাহুবলকে ন্যায়ধর্মের অপেক্ষা বড়ো বলিয়া স্পষ্টতই ঘোষণা করে । সমাজ কদাপি তাহা করিতে পারে না- কারণ, ধৰ্মই তাহার একমাত্র অবলম্বন, স্বার্থকে সর্বদা সংযত করাই তাহার আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় । আমরা যদি বাধি বোলে না ভুলি, যদি 'প্যাট্রিয়টাকেই সর্বোচ্চ বলিয়া না মনে করি, যদি সত্যকে ন্যায়কে ধর্মকে ন্যাশনালত্বের অপেক্ষাও বড়ো বলিয়া জানি, তবে আমাদের ভাবিবার বিষয় বিস্তর আছে। আমরা নিকৃষ্ট আদর্শের আকর্ষণে কপটতা প্রবঞ্চনা ও অসত্যের পথে পা বাড়াইয়াছি কি না, তাহা চিন্তা করিয়া দেখিতে হইবে। এবং ধর্মের দিকে না তাকাইলেও সুবুদ্ধির হিসাব হইতে এ কথা পর্যালোচনা করিতে হইবে যে, ন্যাশনাল স্বার্থের আদর্শকে খাড়া করিলেই বিরোধের আদর্শকে খাড়া করা হয়- সেই আদর্শ লইয়া আমরা কি কোনোকালে য়ুরোপের মহাকায় স্বাৰ্থদানবের সহিত লড়াই করিয়া উঠিতে পারিব ? আমরা লড়াই করিতে পারি জ্ঞানে, ধর্মে। সেখানে আমাদের পৈতৃক মূলধন আছে। সেখানে কেহ আমাদিগকে ঠেকাইবে না- সেখানে পিতৃলোক এবং দেবতা আমাদের সহায় হইবেন এবং বাধি বোলে যদি না ভুলি তবে ইহা জানা উচিত যে, সেখানে যে মহত্ত্বের উপাদান আছে তাহা সকল মহত্ত্বের উচে । কিন্তু এরূপ উপদেশ শুনা যায় যে, প্রকৃতির নিয়ম বিরোধ, অতএব বিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে । বাহির যদি আমার বিরুদ্ধ হয় তবে আমিও তাহার বিরুদ্ধ না হইলে বাচিতে পারিব না । এইজন্য শিশুকাল হইতে ভিন্নজাতির সহিত বিরোধভাবের একান্ত চর্চাই “প্যাট্রিয়টার সাধনা | হিন্দুজাতি সেই পোলিটিকাল বিরোধভাবের চর্চাকেই সকল সাধনার অপেক্ষা প্রাধান্য দেয় নাই বলিয়াই নষ্ট হইয়াছে । পূর্বোক্ত কথাটি যদি একান্তই স্বীকার করিতে হয় তবে সেইসঙ্গে এ কথাও বলিব, আত্মরক্ষাই মানুষের অথবা লোকসম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্ম নহে। ধর্মে যদি নাশ করে তবে তাহাতেই মাথা পাতিয়া দিতে হইবে । ন্যাশনালধর্মেও সকল সময়ে রক্ষা করে না। ক্ষুদ্র বোয়ার জাতি যে লড়িতে লড়িতে নিঃশেষ হইবার দিকে চলিয়াছে’- কিসের জন্য ? তাহাদের হৃদয়ে ন্যাশনালধর্মের আদর্শ অত্যন্ত প্ৰবল হইয়া উঠিয়াছে বলিয়াই। সে ধর্মে তাহাদিগকে রক্ষা করিল কই ? তা ছাড়া বিনাশের চেহারা অনেক সময় ছদ্মবেশী। অনেক সময় পরিপূর্ণ সম্পদ তাহার মুখোশের মতো । কথিত আছে, ক্ষয়কাশে রোগীর কপোলে রক্তিম-লাবণ্য ফুটিয়া উঠে । সম্প্রতি উত্তরোত্তর ব্যাপ্যমান মিলিটারিত্বের রক্তিমােয় যুরোপের গণ্ডস্থল যে টকটকে হইয়া উঠিতেছে, সে কি স্বাস্থ্যের লক্ষণ ? তাহার ন্যাশনালত্বের ব্যাধি অতিমেদস্ফীতির ন্যায় তাহার হৃদয়কে, তাহার মর্মস্থানকে, তাহার ধর্মনীতিকে আক্রমণ করিতেছে, ইহা কি আমরা প্ৰত্যহ দেখিতে পাইতেছি না ? Վ. অধমেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি | ততঃ সপত্নান জয়তি সমুলপ্ত বিনশ্যতি | অধর্মের দ্বারা আপাতত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, কুশলী লাভ করে, শত্রুদিগকে জয় করিয়াও থাকে- কিন্তু সমুলে বিনষ্ট হইয়া যায়। প্রকৃতির নিয়মের প্রতি প্রকৃতিতত্ত্ববিদ যুরোপের যেরূপ অটল বিশ্বাস, ধর্মের প্রতি ধর্মতত্ত্ববিদ হিন্দু সেইরূপ একান্ত বিশ্বাস প্রকাশ করিয়া পূর্বোক্ত শ্লোক উচ্চারণ করিয়াছেন। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যভিচারেই যে ধ্রুব মৃত্যু তাহা নহে, ধর্মনিয়মের ব্যভিচারেও ধ্রুব বিনাশ। ধার্মনীতিক নিয়মের অমোঘত্বে যুরোপ শ্রদ্ধা হারাইতেছে দেখিয়া, আমরাও যেন না হারাইয়া বসি । আমাদের রাজার এক চোখ কানা বলিয়া আমাদের দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন চােখের উপরে যেন পাগড়ি টানিয়া না দিই। নদী তাহার দুই তটভূমির মধ্য দিয়া তাঁটহীন সমুদ্রের দিকে চলিয়াছে। নদীকে যদি তাহার তটের মধ্যেই সম্পূর্ণ বদ্ধ করিবার জন্য বাঁধ দেওয়া যায়, তবে তাহা উচ্ছসিত হইয়া তটকে প্লাবিত ও বিনষ্ট