পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VS রবীন্দ্র-রচনাবলী করে। প্রাকৃতিক নিয়ম জড় হইতে সচেতনে ধর্মপরিণামের দিকে নিয়ত ধাবিত ৷ সেই পরিণামের দিকে তাহার গতিকে বাধা দিয়া যদি তাহাকে বর্তমানের আদর্শেই একেবারে বঁাধিয়া ফেলা যায়, তবে তাহা ভীষণ হইয়া প্ৰলয় সাধন করে। স্বার্থে আদর্শ, বিরোধের আদর্শ যতই দৃঢ়, যতই উচ্চ, যতই রন্ধহীন হইয়া ধর্মের গতিকে বাধা দিতে থাকে ততই তাহার বিনাশ আসন্ন হইয়া আসে। য়ুরোপের নেশনতন্ত্রে এই স্বার্থবিরোধ ও বিদ্বেষের প্রাচীর প্রতিদিনই কঠিন ও উন্নত হইয়া উঠিতেছে। নেশনের মূলপ্রবাহকে অতি নেশনত্বের দিকে, বিশ্বনেশনত্বের দিকে যাইতে না দিয়া, নিজের মধ্যেই তাহাকে বদ্ধ করিবার চেষ্টা প্রত্যহ প্রবল হইতেছে । আগে আমার নেশন, তার পরে বাকি আর-সমস্ত কিছু, এই স্পর্ধ সমস্ত বিশ্ববিধানের প্রতি ভুকুটিকুটিল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিতেছে। তাহার প্রলয়পরিণাম যদি-বা বিলম্বে আসে, তথাপি তাহা যে কিরূপ নিঃসন্দেহ, কিরূপ সুনিশ্চিত, তাহা আর্যধ্বষি দৃঢ়কণ্ঠে বলিয়া গিয়াছেন অধমেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি | ততঃ সপত্নান জয়তি সমুলস্ত বিনশ্যতি || এই ধর্মবাণী সকল দেশের সকল কালের চিরন্তন সত্য, ন্যাশনালত্বের মূলমন্ত্র ইহার নিকট ক্ষুদ্র ও ক্ষণিক । নেশন শব্দের অর্থ যখন লোকে ভুলিয়া যাইবে তখনো এ সত্য অন্নান রহিবে এবং ঋষি-উচ্চারিত এই বাক্য স্পর্ধামদমত্ত মানবসমাজের উর্ধের্ব বজমস্ত্রে আপনি অনুশাসন প্রচার করিতে থাকিবে । . > ○のbr রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি । এলাহাবাদে সোমেশ্বর দাসের কারাবারোধের কথা সকলেই জানেন । কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি অবিচার মাসিকপত্রের আলোচ্য বিষয় নহে। কিন্তু বর্তমান ব্যাপারটি ব্যক্তিবিশেষকে অবলম্বন করিয়া সমস্ত ভারতবাসীর প্রতি লক্ষনিবেশ করিয়াছে । সেইজন্য এ সম্বন্ধে সংক্ষেপে গুটিকয়েক কথা বলিতে হইতেছে । পায়োনিয়র লিখিতেছেন, ভারতবর্ষে নানাজাতীয় লোক একত্রে বাস করে । ইহাদের মধ্যে শান্তিরক্ষা করিয়া চলা ব্রিটিশ গবর্মেন্টের একটি দুরূহ কর্তব্য। সুতরাং যে ঘটনায় ভিন্নজাতির মধ্যে সংঘর্ষ বাধিবার সম্ভাবনা হয়, সেটার প্রতি বিশেষ কঠিন বিধানের প্রয়োজন ঘটে । সে হিসাবে সোমেশ্বর দাসের কারাদণ্ডকে গুরুদণ্ড বলা যায় না । সুয়োগ্য ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিয়ু ইন্ডিয়া পত্রে পায়োনিয়রের এই সকল যুক্তির অযথার্থতা ভালোরূপেই দেখানো হইয়াছে। ইংরেজের যে-সকল ব্যবহারে ভারতবাসীর মনে বিক্ষোভ উপস্থিত হয় ইংরেজ বিচারক তাহাকে যে কত লঘুভাবে দেখিয়া থাকে তাহার শত শত প্রমাণ প্রত্যহ দেখিতে পাই। এই সেদিন একজন সন্ত্রান্ত ব্ৰাহ্মণকে কোনো ইংরেজ পাদুকা বহন করাইয়াছিল- দেশের উচ্চতম আদালতে পর্যন্ত স্থির হইয়া গেছে, ব্যাপারটা অত্যন্ত তুচ্ছ । * তুচ্ছ হইতে পারে, কিন্তু পায়ােনিয়রের যুক্তি অনুসারে তুচ্ছ নহে। ভদ্র ব্ৰাহ্মণের এরূপ নিষ্ঠুর অপমান ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত গুরুতর । তাহা হইলে কথাটা কী দাড়াইতেছে, বুঝিয়া দেখা যাক। যে-সকল জাতিlaw-abiding, অর্থাৎ বিনা বিদ্রোহে আইন মানিয়া চলে, তাহাদেরই অপমান আদালতের কাছে তুচ্ছ। যাহারা কিছুতেই শান্তিভঙ্গ করিবে না, তাহাদিগকে অন্যায় আঘাত করাও অল্প অপরাধ। আর যাহারা অসহিষ্ণু, যাহারা নিজের আইন নিজে চালাইয়া বসে, সংগত কারণেও তাঁহাদের গায়ে হাত দিবার উপক্ৰমমাত্র অপরাধ । ১ দ্রষ্টব্য : 'ব্ৰাহ্মণ প্রবন্ধ, ভারতবর্ষ, রবীন্দ্র-রচনাবলী ৪ (সূলভ সংস্করণ ২)