পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট “ለዪ9© ব্রিটিশরাজ্যে বাঘে গোরুতে এক ঘাটে জল খাওয়াইবার উপায় বাঘকে দমন করিয়া নহে, গোরুটারই শিং ভাঙিয়া । কিন্তু পায়োনিয়রের এ কথাটা লইয়া রাগ করিতে পারি না। পায়োনিয়র বন্ধুভাবে আমাদিগকে একটা শিক্ষা দিয়াছেন। বস্তুতই বারুদে আগুন দেওয়া যতবড়ো অপরাধ, ভিজা তুলায় আগুন দেওয়া ততবড়ো অপরাধ নহে। যাহারা চিরসহিষ্ণু তাহাদের অপমানকে অপরাধ বলিয়া গণ্য করা যাইতে পারে না । অতএব আঘাত অপমান সম্বন্ধে আমরা আইন বঁাচাইব, কিন্তু আইন আমাদিগকে বাচাইবে না। Mild {{induদের প্রতি পায়ােনিয়রের ইহাই নিগুঢ় বক্তব্য । আর-একটা কথা । বিচারের নিক্তিতে সক্ষম-অক্ষম এবং কালো-সাদায় ওজনের কমবেশি নাই। কিন্তু পোলিটিকাল প্রয়োজন বলিয়া একটা ভারী জিনিস আছে, সেটা যে দিকে ভর করে সে দিকে নিক্তি হেলে। এ দেশে ইংরেজের প্রতি দেশী লোকের অন্ধ সন্ত্রম একটা পোলিটিকাল প্রয়োজন, অতএব সেরূপ স্থলে সূক্ষ্মবিচার অসম্ভব । ন্যায়বিচারের মতে এ কথা ঠিক বটে যে, ইংরেজের প্রতি দেশী লোক যে ব্যবহার করিয়া যে দণ্ড পায় দেশী লোকের প্রতিও ইংরেজ সেই ব্যবহার করিয়া সেই দণ্ডই পাইবে । আইনের বহিতেও এ সম্বন্ধে কোনো বিশেষ বিধি নাই । কিন্তু পোলিটিকাল প্রয়োজন ন্যায়বিচারের চেয়েও নিজেকে বড়ো বলিয়া জানে । 鸭 এ কথা ঠিক বটে, পাশ্চাত্য সভ্যতার আধুনিক ধর্মশাস্ত্রে পলিটিকস সর্বোচ্চ, ধর্ম তাহার নীচে । যেখানে পোলিটিকাল প্রয়োজন আসন ছাড়িয়া দিবে সেইখানেই ধর্ম বসিবার স্থান পাইবে । পোলিটিকাল প্রয়ােজনে সত্য কিরূপ বিকৃত হইয়া থাকে, অন্য প্রবন্ধে হার্বাির্ট স্পেন্সরের গ্রন্থ হইতে তাহার প্রমাণ উদধূত করা গেছে। পোলিটিকাল প্রয়োজনে ন্যায়বিচারকেও বিকারপ্রাপ্ত হইতে হয়, পায়োনিয়র তাহা একপ্রকারে স্বীকার করিয়াছেন। জজ বার্কিট সোমেশ্বরের ব্যবহারকে audacity অর্থাৎ দুঃসাহস বলিয়াছেন। স্বত্বরক্ষার উপলক্ষে ইংরাজকে বাধা দেওয়া যে দুঃসাহস, বিচারকই তাহা দেখাইয়াছেন, এবং এই সাহসিকতার অপরাধে সম্রান্ত ব্যক্তিকে কারাদণ্ড দিয়া বিচারক যে মানসিক গুণের পরিচয় দিয়াছেন তাহাকে আমরা কোনােমতেই সাহসের কোটায় ফেলিতে পারি না। বস্তুত তিনি অবাস্তর কারণে সোমেশ্বরের প্রতি অপক্ষপাত ন্যায্য বিচার করিতে সাহসই করেন নাই। এ স্থলে দণ্ডিত যদি audacious হয় তবে দণ্ডদাতার প্রতি ইংরাজি কোন বিশেষণ প্রয়োগ করা। পারে । কিন্তু এইরূপ বিচারের ফলাফলকে আমরা তুচ্ছ বলিয়া সাপ্তাহিক পত্রের এক প্যারাগ্রাফের মধ্যে তাহার সমাধি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিতে পারি না। আমরা প্রতিদিন নানা দৃষ্টান্তের দ্বারা শিখিতেছি যে, পোলিটিকাল প্রয়োজনের যে বিধান, তাহা ন্যায়ের বিধান সত্যের বিধানের সঙ্গে ঠিক মেলে না । ইহাতে আমাদের শিক্ষাদাতাদের ইষ্ট বা অনিষ্ট কী হইতেছে তাহা লইয়া দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবার প্রয়োজন দেখি না । ভয়ের কারণ এই যে, আমাদের মন হইতে ধ্রুবধর্মে বিশ্বাস শিথিল, সত্যের আদর্শ বিকৃত হইয়া যাইতেছে। আমরাও প্রয়োজনকে সকলের উচ্চে স্থান দিতে উদ্যত হইয়াছি। আমরাও বুঝিতেছি, পোলিটিকাল উদ্দেশ্যসাধনে ধর্মবুদ্ধিতে দ্বিধা অনুভব করা অনাবশ্যক। অপমানের দ্বারা যে শিক্ষা অস্থিমজ্জার মধ্যে প্ৰবেশ করে সে শিক্ষার হাত হইতে নিজেকে রক্ষা করিব কী করিয়া ? ধর্মকে । যদি অকৰ্মণ্য বলিয়া ঠেলিয়া রাখিতে আরম্ভ করি তবে কিসের উপর নির্ভর করিব ? বিলাতি সভ্যতার আদর্শের উপর ? বিশ্বজগতের মধ্যে এই সভ্যতাটাই কি সর্বাপেক্ষা স্থায়ী ? দুৰ্ভাগ্যক্রমে, যে জিনিসটা প্রত্যক্ষভাবে আমাদের বুকের উপরে চাপিয়া বসে সেটা আমাদের পক্ষে পৃথিবীর সব চেয়ে ভারীআমাদের পক্ষে হিমালয়পর্বতও তাহার চেয়ে লঘু। সেই হিসাবে বিলাতি সভ্যতার নীতিই আমাদের পক্ষে সব চেয়ে গৌরবান্বিত- তাহার কাছে ধর্মনীতি লাগে না । অতএব ইচ্ছা করি আর না করি বিলাত আমাদিগকে ঠেসিয়া ধরিয়া যে-সকল শিক্ষা দিতেছে তাহা গলাধঃকরণ করিতেই হইবে । আমরা ক্লাইভুকে হেস্টিংসকে ডালহােঁসিকে আদর্শ নরোত্তম বলিয়াই স্বীকার করিব, ইংরেজের সহিত ন্যায্য-অন্যায্য সর্বপ্রকার সংঘাত-সংঘর্ষ-স্থলে আমরা ন্যায়বিচারের (28S