পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট ዓ\ኃ(ሱ অকৰ্মণ্য বলো, অবোধ বলো, দুর্বল বলো সহ্য করিয়া যাইব- কারণ, সহ্য করা আমাদের অভ্যাস আছে। কিন্তু হিন্দুজাতির সত্যমিথ্যা নানা অপযশের মধ্যে রিফাইনড় পাশবিকতার অপবাদটা সব চেয়ে অন্যায়। আর এশিয়াটিক-নামক বন্ধনবিহীন একটা প্ৰকাণ্ড বিচিত্র ব্যাপারের সহিত য়ুরোপীয় বলিয়া একটি ক্ষুদ্র ঐক্যবদ্ধ সম্প্রদায়ের পশুত্ব মনুষ্যত্ব বা দেবত্বর তুলনা একেবারেই অসংগত, অনর্থক । একটা মানকচুর সহিত একটা বাগানের তুলনা হইতেই পারে না । এটা একটা অবান্তর কথা । মোটের উপর, সম্পাদক যে প্ৰবন্ধটি লিখিয়াছেন তাহার প্রশংসা করিতেই হইবে । ইহার মধ্যে চাপা কথা ঢের আছে, তাহা চাপাই থাক। আমরা কেবল একটি কথা যোগ করিতে চাই মাত্র । যাহার হাতে শক্তি আছে সে-যে স্বসম্প্রদায়ের দিকে টানিয়া অবিচার করিবে, ইহা মানুষের স্বভাব । ইংরাজিও মানুষ, তাই সে ইংরাজ-ক্রিমিনালকে সাজা দিয়া উঠিতে পারে না। যাহার হাতে শক্তি নাই সে প্রবলের অন্যায়বিচার অগত্যা সহ্য করে, ইহাও মানুষের স্বভাব । আমরাও মানুষ, তাই আমাদিগকে ইংরাজের আক্রমণ চুপ করিয়া সহ্য করিতে হয় । এই এক জায়গায় মনুষ্যত্বের সমনিম্নভূমিতে ইংরাজের সঙ্গে আমরা একত্রে মিলিতে পারিয়াছি। নূতন ইস্কুল হইতে বাহির হইয়া যখন সাম্য স্বাধীনতা মৈত্রী প্রভৃতি বিদেশী বচনগুলি বাংলায় তৰ্জমা করিবার ভার আমরা গ্ৰহণ করিয়াছিলাম তখন আমরা এই জানিতাম যে, য়ুরোপ বাহুবলে প্রবল হইলেও মনুষ্যত্বের অধিকার সম্বন্ধে দুর্বলের সহিত আপনার সাম্য স্বীকার করেন । তখন আমরা ইস্কুলের উত্তীর্ণ ছেলেরা একেবারে অভিভূত হইয়া গিয়াছিলাম। বলিয়ছিলাম, ইহারা দেবতা। আমরা চিরকাল ইহাদিগকে পূজা করিব এবং ইহারা চিরকাল আমাদিগকে প্রসাদ বিতরণ করিবে— ইহাদের সহিত আমাদের এই সম্বন্ধই শাশ্বত । আমরা মনের ভিতর হইতে ইহাদের কাছে সম্পূর্ণ হার মানিয়াছিলাম । আজ যখন বুঝিতেছি। ইহারা আমাদের অসমকক্ষ নহে- আমরাও দুর্বল, ইহারাও দুর্বলআমাদের অক্ষমের দুর্বলতা, ইহাদের সক্ষমের দুর্বলতা- তখন অভিভূতির ভােব কাটিয়া গিয়া আমরা মাথা তুলিতে পারি। ইংরাজ ক্রমাগত আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছে, ‘ন্যায়পরতা প্রভৃতি সম্বন্ধে তোমাদের স্বশ্রেণীর কোনো জাতির সহিত আমাদের তুলনাই হয় না।” এক সময়ে ইংরাজ যেন এই ধর্মশ্রেষ্ঠতার প্রেস্টিজ চালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল । যে ব্যক্তি অক্ষামের নিকট ধর্মরক্ষা করিয়া চলে তাহার কাছে হার না মানিয়া থাকা যায় না- সেকালে আমাদের মন হার মানিয়াছিল । এখন ইংরাজ প্ৰতাপের প্রেস্টিজ সর্বােগ্রগণ্য করিয়াছে- স্বদেশী ও এদেশীকে ধর্মের চক্ষে সমান করিবার বল ও সাহস এখন তাহার নাই— এখন ইংরাজের কাছে ইংরাজ গবমেন্ট দুর্বল। এখন ম্যাঞ্চেস্টার রাজা, বার্মিংহ্যাম রাজা, নীলকর রাজা, চা-কর রাজা, চেম্বর অফ কমার্স রাজ- তাই আজকাল আমাদের প্রতি ভয় দ্বেষ ঈর্ষার নানা লক্ষণ দেখিতে পাই । দেখি, এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হইতে আমরা তাড়া খাইতেছি, আপিস হইতে ভ্ৰষ্ট হইতেছি, ডাক্তারিশিক্ষায় বাধা পাইতেছি, বিজ্ঞানশিক্ষায় গৃঢ়ভাবে প্রতিহত হইতেছি । ইহাতে আমাদের অনেক অসুবিধা আছে, কিন্তু এই সাস্ত্ৰনাটুকু পাইতে পারি যে, কর্তারা আমাদের চেয়ে বেশি বড়ো নহে। ইহারা আমাদের অগ্রাহ্য করিয়া বঁাচে না- ইহাদের মনে এ আশঙ্কাটুকু আছে যে, সুযোগ পাইলে আমরা বিদ্যায় ক্ষমতায় ইহাদের সমান হইয়া উঠিতে পারি। ইংরাজ-ক্রিমিনাল দেশীয়ের প্রতি অন্যায় করিয়া ন্যায়সংগত শান্তি পাইলে ইংরাজকে দেশীয় আপন সমতুল্য বলিয়া জ্ঞান করিবে, এই ভয়টুকু যখন ইংরাজের মনে প্রবেশ করিয়াছে, তখন তাহার আত্মসম্মান নষ্ট হইয়াছে। এই উপলক্ষে আমাদের চিত্তও ইংরাজের কাছে নতিস্বীকারের দায় হইতে নিষ্কৃতিলাভ করিতেছে- প্রত্যহ তাহার প্রমাণ পাইতেছি। সম্পাদকমহাশয় বলেন, আমরা যদি ঘুষির পরিবর্তে ঘুষি ফিরাইতে পারি, তবে রান্তীয় ঘাটে ইংরাজকে অনেক অন্যায় হইতে নিরন্ত রাখিতে পারি। কথাটা সত্য- মুষ্টিযোগের মতো চিকিৎসা নাই-কিন্তু সম্পাদকের উপদেশ সহসাকেহ মানিতে রাজি হইবে না। তাহার গুটিকতক কারণ আছে। :