পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট - ዒዪ9ዒ মনিব সম্পূর্ণ সমান। সে স্থলে মনিবের দুর্ব্যবহার সহ্য না করিবার প্রভূত বল ভূত্যের আছে। সে বল ভূতের একলার বল নহে, তাহা তাহার সমস্ত স্বজাতির বল। এই বিপুল বলের সহিত একজন দেশীয় ভূত্যের একলার বলের তুলনা করা ঠিক নহে। এখানেও একান্নবর্তী পরিবারের কথা পাড়িতে হয় । একজন ইংরাজের উপর অল্প লোকেরই নির্ভর- আমরা প্ৰত্যেকেই বহুতর আত্নীয়ের সহিত নানা সম্বন্ধে আবদ্ধ । সেই-সকল সম্বন্ধ আমাদিগকে ত্যাগপরতা সংযম মঙ্গলনিষ্ঠা প্রভৃতি মনুষ্যত্বের উচ্চতর গুণে ভূষিত করিয়াছে— সেই সকল সম্বন্ধই হিন্দুজাতিকে রিফাইনড় ও অকৃত্রিম পাশবিকতা হইতে দূরে রাখিয়ছে- আমাদের পক্ষে হঠকারিতা সহজ হইতেই পারে না, আমাদিগকে জেলের দিকে আকর্ষণ করিলে অনেকগুলা শিকড়েই সাংঘাতিক টান পড়ে। অতএব আমাদের জীর্ণ প্লীহা ইংরাজের বুটাগ্রের পক্ষে যেরূপ সহজ লক্ষ্য, ইংরাজের নাসাগ্র আমাদের বদ্ধমুষ্টির পক্ষে সেরূপ সুন্দর সুগম নহে। সেজন্য ইংরাজ যদি নিজেকে আমাদের চেয়ে বেশি বাহাদুর মনে করেন, তো করুন, কিন্তু আমরা কেন ইংরাজের তরফ হইতে স্বজাতিকে বিচার করি ? যে ভাবে আমরা চিরকাল মনুষ্যত্ব চর্চা করিয়া আসিতেছি ইংরাজের সহিত সংঘাতে তাহাতে আমাদের অসুবিধা ও অপমান ঘটিতেছে। তা হইতে পারে, কিন্তু তাই বলিয়া মনুষ্যত্বে আমরা খাটাে এ কথা আমরা তো স্বীকার করিতে পারিব না। মানুষ হইতে গেলে দাত-নখের খর্বতা ঘটিয়া থাকে, তাই বলিয়া কি লজ্জা পাইব ! রোমের সম্রাট নগ্ন-নিরস্ত্ৰ খৃস্টানদিগকে ক্রীড়াঙ্গনে পশু দিয়া হত্যা করিয়াছিলেন- ধর্মরাজ যদি তাহার বিচার করিয়া থাকেন, তিনি কি রোমরাজের পৌরুষকেই সম্মান দিয়াছেন ? আমরা যদি যথার্থভাবে সহ্য করিতে পারি, আমরা যদি সহিষ্ণুতার জন্য নিজেকে হেয় বলিয়া অন্যায় ভ্ৰম না করি, তবে ধর্ম আমাদের বিচার গ্রহণ করিবেন । কিন্তু রচনানীতির খাতিরে বা যে কারণেই হউক, এ কথা আমরা যেন অনায়াসেই উচ্চারণ করিয়া না বসি যে, আমরা হইলেও ঠিক এইরূপ করিতাম বা ইহাদিগকেও ছাড়াইয়া যাইতাম । না, আমরা হইলে এরাপ করিতাম না । ইহাই আমাদের সান্তুনা । আমাদের সমাজের, আমাদের ধর্মের যে আদর্শ, আমাদের শাস্ত্রের যে অনুশাসন, আমাদের স্বভাবের যে গতি, তাহাতে অক্ষমকে আমরা আত্মীয়শ্রেণীভুক্ত করিয়া লইতাম । আমরা ভিক্ষুককে, দুর্বলকে, প্রাচীনকে কখনো অবজ্ঞা করি নাই। রাজা এবং রাজকুটুম্ব ঠিক এক নহে, কিন্তু তবু রাজসম্পর্কের গন্ধ থাকিলেও কুটুম্বদের উৎপাত সহ্য করিতেই হয়। মৃচ্ছকটিকের রাজশ্যালকের কথা পাঠকগণ স্মরণ করবেন । প্রভেদ এই যে, উক্ত কুটুম্ববর্গের সংখ্যা এখন অনেক বাড়িয়া গেছে। মৃচ্ছকটিকের সেই রাজশ্যালকটি যতই উপদ্রব্য করুক-না কেন, প্রজাবর্গের কাছে তাহার সম্মান ছিল না- সকলেই তাহাকে উৎপাত বলিয়াও জানিত, অথচ তাহাকে মনে-মুখে পরিহাস-বিদ্রুপ করিতে ছাড়িত না। এখনকার রাজশ্যালকগণের নিকট হইতে ঠিক সে পরিমাণ হাস্যরস আদায় করা কঠিন, কিন্তু তঁহাদের ব্যবহারে তঁাহারা প্রত্যহ আমাদের কাছে যে পরিমাণে সম্রাম হারাইতেছেন তাহা যেন আমাদের মাথা তুলিবার সহায়তা করে। Sv)SO গত বৈশাখ মাসের বঙ্গদর্শনে ‘রাজকুটুম্বা’-শীর্ষক প্রবন্ধে নিয়ু ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত কোনো রচনার সমালোচনা করা হইয়াছিল। নিয়ু ইন্ডিয়ার সম্পাদকমহাশয় আমাদিগকে ভুল বুঝিয়েছেন। তিনি স্থির করিয়াছেন, এক গালে চড় খাইয়া অন্য গাল ফিরাইয়া দেওয়া যদি-বা। আমাদের মত না হয়, অন্তত অশ্রািজলপ্রবাহে আহতগণ্ডের আঘাত-বেদনার উপশমচেষ্টাই আমাদের মতে শ্ৰেয় । ইংরাজের ঘুষিঘাষা খাইয়া নাকিসূরে নালিশ করা এ দেশে কিছুকাল পূর্বে অত্যন্ত অধিকমাত্রায়