পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓዓo রবীন্দ্র-রচনাবলী উপর বা রাগ করিয়া কাহারও তলপেটে উপযুপরি লাথি মারিতে পারি না, তাহার কারণ আমাদের সাহসের অভাব নহে- তাহার প্রধান কারণ, আমাদের দেশের সামাজিক আদর্শে আমাদিগকে নিরীহ করিয়াছে । ইংরাজ কথঞ্চিৎ পরিহাসের ভঙ্গিতে আমাদিগকে "mild Hindu'বিলিয়া থাকে- বস্তুতই আমরা মাইলড় হিন্দু। ইহাতে আমাদের অসুবিধা ঘটিতেছে তাহা দেখিতেছি, এবং এখন বর্তমান অবস্থায় কী করা কর্তব্য তাহাও বিচাৰ্য- কিন্তু মাইলড় বলিয়া আমাদের লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিবার কথা নহে। ভারতবাসী মৃত্যুকে ভয় করে বলিয়া যে কাহাকেও আক্রমণ করে না তাহা নহেবোয়ার-যুদ্ধে ভারতবষীয় ডুলিবাহকেরাও দেখাইয়াছে যে, তাহারা বিনা উত্তেজনাতেও অবিচলিতভাবে মৃত্যুর মুখের সম্মুখে আপনার কাজ করিয়া যাইতে পারে’— কিন্তু তাহার ধর্ম, তাহার সমাজ তাহার হিংস্রপ্রবৃত্তি লোপ করিয়া দিয়াছে- এতদূর করিয়াছে যে, তাহাতে তাহার স্বার্থহানি ও অসুবিধা ঘটে এবং তাহার মানহানি ঘটিতেছে। এই নিরীহতাকে যদি তিরস্কার করিতে হয়, তবে ভীরুতাকে যে ভাষায় করিবে, ইহাকেও কি সেই ভাষায় করিবে ? যাহাই হউক, ইংরাজের মারা খাইয়া মাির ফিরাইয়া দেওয়া আমাদের পক্ষে কী কী কারণে সহজ নহে, “রাজকুটুম্বা’ প্রবন্ধে তাঁহারই আলোচনার চেষ্টা করিয়াছিলাম। ফিরাইয়া দেওয়া উচিত কি না সে কথা তুলি নাই। কর্তব্য দুঃসাধ্য হইলেও কর্তব্য, বরঞ্চ সে কর্তব্যের গীেরব বেশি। এলাহাবাদের কোনো দেশীয় ধনী ব্যাঙ্কর স্বত্বরক্ষা উপলক্ষে তাহার কোনো ইংরাজ ভাড়াটিয়াকে ফুলগাছের টব লাইতে ভৃত্যদের দ্বারা বাধা দেন- সেই স্পর্ধায় তাহার কারাদণ্ড হয়। স্বত্বরক্ষা বা আত্মরক্ষা বা মানরক্ষার খাতিরে কোনো ইংরাজের গায়ে হাত তুলিলে তাহার পরিণাম সুখজনক না হইতে পারে এ আশঙ্কা স্বীকার করিয়াও যখন আমাদের দেশের লোক আঘাতের পরিবর্তে আঘাত করিতে শিখিবে, তখনই ইংরাজের কাপুরুষতার সংশোধন হইবে- এই অত্যন্ত সহজ কথাটি যদি অস্বীকার করি, তবে স্বভাবের নিয়ম সম্বন্ধে আমার সুগভীর অজ্ঞতা প্রকাশ পাইবে । ” স্বভাবের নিয়মের অপেক্ষা উচ্চতর নীতি আছে। কিন্তু সে নীতি যতক্ষণ পর্যন্ত না সমস্ত বাধা পরাভূত করিয়া নিজেকে দুনিবারভাবে প্রত্যক্ষ করিয়া তোলে, ততক্ষণ পর্যন্ত স্বভাবের নিয়মকেই আশ্রয় করিতে হয় । 粤 কিন্তু এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে যে, এই-যে ঘুষাঘুষির উত্তেজনা আমাদের মনে জাগ্রত হইয়া উঠিতেছে, ইহা আমাদের ধর্মনীতিতে আঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না। অশুভাপ্রবৃত্তি প্রয়োজনটুকু সিদ্ধ করিয়াই অন্তর্ধান করে না। তাহাকে দাসত্বের ছুতায় আহবান করিলেও শেষে সে রাজত্ব করিতে চায় । কোনো কোনো দুৰ্বত্ত মদ না খাইলে যেমন কাজ করিতে পারে না বিদ্বেষ সেইরূপ অন্ধ না হইলে পুরাদমে কাজ করিতে পারে না। গুণ্ডাগিরিকে যদি একবার রীতিমত জাগাইয়া তুলি তবে সে অন্ধবিদ্বেষের নেশায় না মাতিয়া থাকিতে পরিবে না। তখন সে উঠিয়া-পড়িয়া কাজ আরম্ভ করিবে বটে, কিন্তু আমাদের উচ্চতন মনুষ্যত্বের বুকের রক্ত হইতে সে প্রতিদিন তাহার খোরাক আদায় করিতে থাকিবে । গুণ্ডাগিরি বল পাইয়া উঠিয়া মনুষ্যত্বকে শোষণ করে- বাহাদুরির নেশা জাগিয়া ওঠে। এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে, শুদ্ধ উপদেশে কোনো ফল হয় না- অভ্যাস তাহা অপেক্ষা দরকারি জিনিস। মারা উচিত বলিলেই মারা যায় না, মারা অভ্যাস করা চাই। যাহাদের ঘুষি প্রস্তুত ১ স্যাভেজ ল্যােন্ডর নামক ভ্ৰমণকারী যখন তিব্বতভ্ৰমণে গিয়াছিলেন তখন তাহার সমুদয় ভৃত্যই প্রাণভয়ে ষ্ঠাহাকে পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করে, কেবল চন্দনসিং ও মানসিং বলিয়া তাহার যে দুটিমাত্র হিন্দুভূত্য ছিল তাহারা কখনো পলায়নের চেষ্টামাত্রও করে নাই- তাহারা আসন্নমৃত্যুর শঙ্কায় এবং অসহ্য উৎপীড়নেও অবিচলিত থাকে- অথচ নূতন দেশ-আবিষ্কারের উত্তেজনা, সমাজে যশের প্রত্যাশা বা ভ্রমণবৃত্তান্ত ছাপাইয়া অর্থলাভের প্রলোভন, তাহাদের কিছুই ছিল না। তাঁহাদের প্রভুও বিদেশী এবং অল্পদিনের- কিন্তু তাহারা হিন্দু, অন্যকে মারিবার জন্য তাহারা সর্বদাই উদ্যত নয়, অথচ মরিতে ভয় করে না ।