পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট "bró যাহা হউক ‘বয়কট'-যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া আমরা বাহির হইলাম এবং দেশধর্মগুরুর নিকট হইতে স্বরাজমন্ত্রও গ্রহণ করিলাম ; মনে করিলাম। এই সংগ্রাম ও সাধনার যত-কিছু বাধা সমস্তই বাহিরে, আমাদের নিজেদের মধ্যে আশঙ্কার কারণ কিছুই নাই। এমন সময় হঠাৎ আমাদের ভিতরকার বিচ্ছিন্ন অবস্থা বিধাতা এমন সুকঠোর সুস্পষ্ট আকারে দেখাইয়া দিলেন যে, আমাদের চমক লাগিয়া গেল । আমরা নিজেরাই নিজেদের দলনের উপায়, অগ্রসর হইয়া প্ৰতিবন্ধক, এ কথা যখন নিঃসংশয়রূপে ধরা পড়িল তখন এই কথাই আমাদিগকে বলিতে হইবে যে, স্বদেশকে উদ্ধার করিতে হইবে, কিন্তু কাহার হাত হইতে ? নিজেদের পাপ হইতে । ইংরেজ সমস্ত ভারতবর্ষের কঁধের উপরে এমন করিয়া যে চাপিয়া বসিয়াছে, সে কি কেবল নিজের জোরে । আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল । ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটা লক্ষণ মাত্র । লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্ৰতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দেমাতরম মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই। বিদেশী রাজা চলিয়া গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হইয়া উঠিবে তাহা নহে। দেশকে আপন চেষ্টায় আপন দেশ করিয়া গড়িয়া তুলিতে হয়। অন্নবস্ত্ৰ-সুখস্বাস্থ্য-শিক্ষাদীক্ষা দানে দেশের লোকই দেশের লোকের সর্বপ্রধান সহায়, দুঃখে বিপদে দেশের লোকই দেশের জন্য প্রাণপণ করিয়া থাকে, ইহা যেখানকার জনসাধারণে প্রত্যক্ষভাবে জানে সেখানে স্বদেশ যে কী তাহা বুঝাইবার জন্য এত বকবিকি করিতে হয় না। আজ আমাদের ইংরেজি-পড়া শহরের লোক যখন নিরক্ষর গ্রামের লোকের কাছে গিয়া বলে “আমরা উভয়ে ভাই' - তখন এই ভাই কথাটার মানে সে বেচারা কিছুই বুঝিতে পারে। না। যাহাদিগকে আমরা “চাষা বেটা বলিয়া জানি, যাহাদের সুখদুঃখের মূল্য আমাদের কাছে অতি সামান্য, যাহাদের অবস্থা জানিতে হইলে আমাদিগকে গবর্মেন্টের প্রকাশিত তথ্যতালিকা পড়িতে হয়, সুদিনে দুদিনে আমরা যাহাদের ছায়া মাড়াই না, আজ হঠাৎ ইংরেজের প্রতি স্পর্ধা প্রকাশ করিবার বেলায় তাহাদের নিকট ভাই-সম্পর্কের পরিচয় দিয়া তাহাদিগকে চড়া দামে জিনিস কিনিতে ও গুর্থার ওঁতা খাইতে আহবান করিলে আমাদের উদ্দেশ্যের প্রতি সন্দেহ জন্মিবার কথা । সন্দেহ জন্মিয়াও ছিল। কোনো বিখ্যাত ‘স্বদেশী-প্রচারকের নিকট শুনিয়াছি যে, পূবর্বঙ্গে মুসলমান শ্রোতারা তঁহাদের বক্তৃতা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিয়াছে যে, বাবুরা বােধ করি বিপদে ঠেকিয়াছে। ইহাতে র্তাহারা বিরক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু চাষা ঠিক বুঝিয়েছিল। বাবুদের স্নেহভাষণের মধ্যে ঠিক সুরাটা যে লাগে না তাহা তাহাদের বুঝিতে বিলম্ব হয় নাই। উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষে প্রেমের সম্বন্ধ পাতাইতে গেলে ক্ষুদ্রব্যক্তির কাছেও তাঁহা বিস্বাদ বোধ হয়— সে উদ্দেশ্য খুব বড়ো হইতে পারে, হউক তাহার নাম “বয়কটা বা ‘স্বরাজ', দেশের উন্নতি বা আর-কিছু। মানুষ বলিয়া শ্ৰদ্ধাবশত ও স্বদেশী বলিয়া স্নেহবশত আমরা যদি সহজেই দেশের জনসাধারণকে ভালোবাসিতাম, ইংরেজি শিক্ষায় আমাদের পরস্পরের মধ্যে বিচ্ছেদ না ঘটাইয়া মিলনকে যদি দৃঢ় করিতে পারিত, তাহাদের মাঝখানে থাকিয়া তাহাদের আপনি হইয়া তাহাদের সর্বপ্রকার হিতসাধনে যদি আমাদের উপেক্ষা বা আলস্য না থাকিত, তবে আজ বিপদ বা ক্ষতির মুখে তাহাদিগকে ডাক পাড়িলে সেটা অসংগত শুনিতে হইত না। হিন্দু-মুসলমান এক হইলে পরস্পরের কত সুবিধা একদিন কোনাে সভায় মুসলমান শ্রোতাদিগকে তাহাই বুঝাইয়া বলা হইতেছিল। তখন আমি এই কথাটি না বলিয়া থাকিতে পারি নাই যে, সুবিধার কথাটা এ স্থলে মুখে আনিবার নহে ; দুই ভাই এক হইয়া থাকিলে বিষয়কর্মভালো চলে, কিন্তু সেইটেই দুই ভাই এক থাকিবার প্রধান হেতু হওয়া উচিত নহে। কারণ, ঘটনাক্রমে সুবিধার গতি পরিবর্তন হওয়াও আশ্চর্যকর নহে। আসল কথা, আমরা এক দেশে এক সুখদুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, আমরা যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধৰ্ম। আমরা উভয়েই এক দেশের } সন্তান- আমরা ঈশ্বরকৃত সেই ধর্মের বন্ধন্যবশত, শুধু সুবিধা নহে, অসুবিধাও একত্রে ভোগ করিতে প্রস্তুত যদি না হই তবে আমাদের মনুষ্যত্বে ধিক। আমাদের পরস্পরের মধ্যে, সুবিধার চর্চা নহে, । প্রেমের চর্চা, নিঃস্বাৰ্থ সেবার চর্চা যদি করি তবে সুবিধা উপস্থিত হইলে তাহা পুরা গ্ৰহণ করিতে পারিব